যীশু খ্রীষ্ট হলেন মানবজাতির ইতিহাসে
সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাক্তি। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে তাঁকে নিয়ে ইহুদীদের মধ্যে
যেমন বিস্ময়ের কোন সীমা ছিল না, বর্তমান যুগেও তেমনি ভাবে অগণিত মানুষের মধ্যে তাঁকে
নিয়ে কৌতূহল আর প্রশ্নের শেষ নেই। সারা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে যে পরিমাণ বইপত্র লেখা হয়েছে,
আর অন্য কোনও ব্যাক্তি কে নিয়ে তত পরিমাণ লেখালিখি করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
যীশু খ্রীষ্টের শিষ্যদের লেখা মঙ্গলসমাচার বা Gospel থেকে আমরা তাঁর
জীবন কাহিনীর বিবরণ পাই। যীশু খ্রীষ্টের এই শিষ্যরা, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে সময় কাটিয়েছিলেন
এবং তাঁর মুখ থেকে যা কিছু শুনে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে তথ্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, আজ
আমরা সেই সব পাণ্ডুলিপিকে একত্রে নতুন নিয়ম বা New Testament নামে জানি।
তবে যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে লেখা এমন অনেক বইপত্রও আছে যেগুলো কাল্পনিক, অতিরঞ্জিত কাহিনী,
অঐতিহাসিক উপন্যাস এবং রয়েছে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এই সমস্ত কাহিনী খ্রীষ্টের জন্মের
৩০০ বছর পর থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে লেখা হয়েছে। যারা এই সমস্ত কাহিনী কিংবা বইপত্র
লিখেছেন তাদের কেউ কিন্তু প্রেরিত শিষ্যদের একজন নন, প্রেরিত শিষ্যদের তারা নিজেদের
চোখে দেখেনি কিংবা তাঁদের মুখ থেকে সরাসরি যীশু খ্রীষ্টের জীবন কাহিনী ও ধর্মশিক্ষার
বিষয়ে কিছু শোনেন নি। তাই ঐ সমস্ত লেখা ও কাহিনীগুলো খ্রীষ্টধর্মে কোন দিনও বৈধ সাক্ষ্য
এবং ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। ক্যাথলিক মণ্ডলীতে ঐ সমস্ত বইপত্র ও কাহিনীগুলিকে
অসত্য বলে বাতিল করা হয়েছে। ঠিক ওই একই কারণে যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে ইসলাম ধর্মে বলা
কোরানের বক্তব্যকে অসত্য বলে বাতিল করেছে ক্যাথলিক মণ্ডলী। কারণ কোরান ঐতিহাসিক ভাবে
দাবী করে যে যীশু খ্রীষ্ট ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মারা যাননি, তাঁকে আল্লাহ নাকি সরাসরি স্বর্গে
নিজের কাছে রেখেছেন (কোরান ৩:৫৫, ৪:১৫৭)। যীশু
খ্রীষ্টের মৃত্যু যে ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার কারণেই হয়েছিল এই নিয়ে ইতিহাসবিদরা কোনও দ্বিমত
পোষণ করেন না। কারণ যীশুর মৃত্যু কি ভাবে হয়েছে এ বিষয়ে প্রাচীন রোমান পাণ্ডুলিপিতে
তার উল্লেখ আছে। এমনকি বর্তমান যুগের ইহুদীরাও স্বীকার করে যে তাদেরই পূর্বপুরুষ যীশুকে
হত্যা করেছে। তবে এখানে একটা কথা সকলকে মনে রাখা দরকার যে, কোরানের ‘ইসা’ আর
বাইবেলের ‘যীশু খ্রীষ্ট’ ঐতিহাসিক ভাবে কিন্তু এক ব্যাক্তি নন। কোরানের ইসা
আসলে এক নকল যীশু!
প্রায় ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে
বিশেষ ভাবে ভারতে এবং ইউরোপ মহাদেশের বেশ কিছু জায়গায় যীশু খ্রীষ্টকে নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব (Conspiracy Theory) প্রচারিত হয়ে আসছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী যীশু খ্রীষ্ট
১৩ বছর বয়সে ভারতে এসে হিন্দু এবং বৌদ্ধ গুরুদের কাছ থেকে নাকি আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও
বিশেষ কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি অর্জন করেছিলেন। এবং পরে তিনি আবার নিজের দেশে ফিরে গিয়ে
সেখানে আত্ম প্রকাশ করেন। হিন্দুদের মতে যীশু নাকি হিন্দুধর্মের জ্ঞান করছিলেন। এদিকে
বৌদ্ধরা বলে থাকেন তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানজ্বলিত ব্যাক্তি (Enlighten Person), তিনি
নিজেই একজন মহাজ্ঞানী ছিলেন। যদি আপনি ঠাকুমার ঝুলি বা গোপাল ভাঁড়ের মতো গল্প শুনে
নিজেকে কল্পনার জগতে ভাসাতে ভালবাসেন, তাহলে তো আপনার কাছে যীশু খ্রীষ্টের ভারতে আসার
গল্পটা বেশ লাগবে। কিন্তু যারা সত্যসন্ধানি মানুষ, যারা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে, তারা
জানে এটা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তব এবং কাল্পনিক এক কাহিনী! কিন্তু প্রশ্ন হল, “যীশু
খ্রীষ্ট ভারতে ছিলেন!”, এই তত্ত্বের আবির্ভাবে হল কী ভাবে? এই বিষয় নিয়েই আমি বিস্তারিত
ভাবে জানাবো।
যীশু খ্রীষ্টের ভারতে আসার
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কী ভাবে প্রচারিত হল? এর উৎপত্তি হল কী ভাবে?
মঙ্গলসমাচারের পাতায় যীশু খ্রীষ্টের
জীবনের প্রায় ১৮ বছরের জীবন কাহিনী সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের কাছে বিস্তারিত ভাবে কোনও
তথ্য তুলে ধরেনি। যীশু খ্রীষ্টের ১২ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২৯ বছর বয়স অবধি এই বছরগুলিকে
শাস্ত্রবিদদের ভাষায় – “যীশু খ্রীষ্টের গোপন জীবন” বা “যীশু খ্রীষ্টের অজানা
জীবন” বলা হয়ে থাকে। তাঁর এই অজানা জীবন নিয়েই মানুষের যত জল্পনা কল্পনা। আর এখান
থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অজানা ও গোপন জীবন নিয়ে লেখা নানা ধরণের আসারে গাল-গল্প।
১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে, ফ্রান্সে,
নিকোলাস নোটোভিটচ (Nicolas Notovitch)
নামের একজন রূশীয় সাংবাদিক ও অভিযাত্রী একটি
বই প্রকাশ করেন যার নাম – “La vie inconnue de
Jesus Christ”, বাংলায় এর অর্থ – “যীশু খ্রীষ্টের অজানা
জীবন”। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপের বিভিন্ন প্রধান ভাষাতে এটা অনুবাদ
করা হয়। এবং এরই সাথে ইউরোপের বাইরের দেশগুলির কথা মাথায় রেখে আরও অন্যান্য ভাষাতেও
এই বই অনুবাদ করা হয়েছিল। এই বই ইংরেজি ভাষায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।
সে সময় মানুষের মধ্যে বইটা এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, তা ধর্মতাত্ত্বিক, ইতিহাসের
গবেষক এবং একাডেমিক স্তরের শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। এর ফলস্বরুপ
এই বই পড়বার পর শিক্ষিত মহল, বিশেষ করে ইতিহাসের গবেষকদের কাছ থেকে এ বই অনেক নিন্দা
কুড়িয়েছে এবং তাঁরা এই বইকে – “আধুনিক যুগের জালবাজি” বা “Modern
Forgery” বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই বইয়ে মোট ১৪টি অধ্যায় আর ২৪৪টি অনুচ্ছেদ আছে।
নিকোলাস নোটোভিটচ কি ভাবে যীশুর হারানো জীবনকে
আবিষ্কার করেছেন সেই কথা দিয়েই নিজের বক্তব্য শুরু করেন। তিনি লিখেছেন, ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে
তিনি ভারত ও কাশ্মীরে ভ্রমণ করতে গিয়ে বৌদ্ধ লামাদের কাছ থেকে ‘ইসা’ নামের একজন
নবীর তিব্বতীয় গল্প শোনেন। আরবিতে মুসলিমদের কাছে যিনি হলেন যীশু। এরপর নোটোভিটচ লাদাখের
দিকে, তিব্বত ও ভারতের সীমায় অবস্থিত হেমিস (Hemis) নামের একটি প্রসিদ্ধ তিব্বতীয়
বৌদ্ধ মঠে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে থাকবার সময় তিনি নাকি ইসা নামে পরিচিত এই নবীর প্রচলিত
অনেক কাহিনী বৌদ্ধ লামাদের কাছ থেকে শোনেন এবং তাঁর নামে লেখা অনেক পুঁথিপত্রও যে আছে সে কথাও তাকে জানানো হয়। এই ইসার বিষয়ে আরও বিস্তারিত
ভাবে না জেনেই নোটোভিটচ সেই মঠ ছেড়ে পুনরায় যাত্রা
শুরু করেন। যাত্রা শুরু করবার দু-তিন পরেই তার সাথে এক দুর্ঘটনা ঘটে,
তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে নিজের পা ভেঙ্গে ফেলেন। তড়িঘড়ি তাকে আবার সেই মঠে ফিরিয়ে নিয়ে
আসা হয়। মঠাধ্যক্ষ সেখানে তার সেবা-শুশ্রুষার সমস্ত ব্যাবস্থা করে দেন। সেখানে থাকবার
সময়ে নোটোভিটচের সাথে মঠাধ্যক্ষের
একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নোটোভিটচ পুনরায়
সেই ইসা নামের নবীর কথা পাড়েন, তাঁর সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত ভাবে জানতে আগ্রহ প্রকাশ
করেন। নোটোভিটচের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে মঠাধ্যক্ষ তার সামনে এমন
দুটো মোটা খণ্ডের (Volume) পুঁথি নিয়ে আসেন যা তিব্বতীয় ভাষায় লেখা ছিল। তিনি নোটোভিটচের সামনে তিব্বতীয় ভাষায় লেখা সেই পুঁথি থেকে পড়তে
থাকেন এবং নোটোভিটচের সঙ্গে থাকা তার দোভাষী সে সব কথা তার ভাষায় বলতে থাকে, আর নোটোভিটচ
সে সব কথা একটা জায়গায় লিখতে থাকেন। নোটোভিটচ তার বই- “La
vie inconnue de Jesus Christ” এ লিখেছেন যে এই ‘ইসা’
নাকি আসলে ‘যীশু খ্রীষ্ট’। নোটোভিটচ লিখেছেন, যীশুর বয়স যখন ছিল ১৩ বছর, সে সময় যীশু নাকি ভারতীয়
ধর্মশাস্ত্র নিয়ে জ্ঞান অর্জন করবার জন্য কোন এক নাম না জানা বণিকদের যাত্রীদলে যোগ
দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান। যীশু ভারতে পৌঁছে হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সাথে
প্রায় ছয় বছর কাটিয়ে বেদ সহ ও অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু
যীশু ভারতীয় হিন্দু ধর্মের মধ্যে থাকা “বর্ণপ্রথার” বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু
করলে ব্রাহ্মণরা যীশুকে হত্যা করবে বলে সিধান্ত নেয়। এরপর যীশু নাকি হিন্দুদের কাছ
থেকে পালিয়ে গিয়ে বৌদ্ধদের একটি দলে গিয়ে যোগ দেন, তাদের কাছ থেকে পালি ভাষা শেখেন,
এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেই পাণ্ডিত্য অর্জন করার পর যীশু পারস্য
(বর্তমানে ইরান) দেশে গিয়ে সেখানে জরথুষ্ট্রবাদদের (Zoroastrianism) কাছে বৌদ্ধ ধর্মের
প্রচার করেন। এবং সবশেষে, ২৯ বছর বয়সী যীশু, ভারতীয় ধর্মগুলির শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে
প্যালেস্টাইনে ফিরে এসে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। যীশুর মৃত্যুর পর নাকি
একজন ইহুদী বণিক ভারতে গিয়ে যীশুর জীবনের সমস্ত কথা সেই সমস্ত মানুষকে গিয়ে বলে যারা
যীশুকে ‘ইসা’ নামে আগে থেকেই চিনতো এবং তারা ‘ইসা’র সে সব কাহিনী একটা পুঁথিতে ভালো
ভাবে লিখে রাখে। এটাই হল নোটোভিটচের লেখা
“La vie inconnue de Jesus Christ”
বইয়ের সারমর্ম!
La vie inconnue de Jesus Christ একটা কাল্পনিক ও অসত্য গল্পের বই!
নোটোভিটচের লেখা এই বই যে একটা
কাল্পনিক, অসত্য এবং গাঁজাখুরিতে ভরা এক বই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বাজারে সস্তা
দামে যে সমস্ত মন ভোলান উপন্যাস কিনতে পাওয়া যায়, “La
vie inconnue de Jesus Christ” হল একেবারে ওই মানের একটা বই। যীশু খ্রীষ্টের সাথে
ভারত তো দূরের কথা, হিন্দু ধর্ম কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের দূর দূর পর্যন্ত কোনও সম্পর্কই
নেই। বইটা অবাস্তব ও ভুলেতে ভরা হলেও এটাকে যীশুর জীবনের ঐতিহাসিক বিবরণ বলে প্রচার
করা হয়েছে। এই বইটা সফলতা অর্জন করবার পিছনে থাকা মূল কারণ ছিল কয়েকটা প্রশ্ন, যেমনঃ
“বাইবেলে যীশুর ১৮ বছরের জীবন কাহিনী কেন লেখা হয়নি? সে সময় যীশু কোথায় ছিলেন? তিনি
কী করছিলেন?”…ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে বাইবেলে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে বটে,
কিন্তু খ্রীষ্টানরা কোনদিনই যীশুর অজানা জীবন নিয়ে জানবার বা প্রচার করবার জন্য নিজেদের
মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেনি। যীশুর প্রকাশিত জীবনের যা কিছু মানুষের কাছে বহুকাল আগেই তুলে
ধরা হয়েছে, তাতেই অনেক মানুষ সে সব কথা হজম করতে না পেড়ে হিমশিম খাচ্ছে, তাহলে তাঁর
সম্বন্ধে যা কিছু গোপনেই রাখা হয়েছে তা জানলে মানুষের মনের অবস্থাটা কেমন হবে? যারা
সাধারণ বিষয় বিশ্বাস করতে পারে না, তারা অসাধারণ বিষয় কী ভাবে বিশ্বাস করবে?
যাইহোক, যীশু খ্রীষ্টের
অজানা জীবন নিয়ে লেখা এই বইটা যে ঐতিহাসিক ভাবে ভুল এবং কল্পনার আশ্রয় নিয়ে লেখা হয়েছে
সে কথা অনেক ইতিহাসবিদ এবং বাইবেলের গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন। সর্বপ্রথম যিনি এই কাজটি
করেন, তিনি হলেন ম্যাক্স মুলার (Max Müller), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী এবং ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি
ও ইতিহাসের একজন পণ্ডিত-গবেষক (Indologist)। ভারতের ইতিহাস ও ধর্মের বিষয়ে তাঁর মতো
জ্ঞানী মানুষ এই পৃথিবীতে আর দুটো নেই। তিনি বলেছেন, যীশু খ্রীষ্টের ভারতে যাত্রা করা
এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা গ্রহণ করবার এই পুরো কাহিনীটাই আসলে একটা ধাপ্পাবাজি!
এটা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব এক কাহিনী! ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে একজন ইংরেজ মহিলা “La vie inconnue de Jesus Christ” পড়বার পর হেমিস (Hemis) নামের ওই বৌদ্ধ মঠ পরিদর্শন করতে ভারতে যান।
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনুসন্ধান করবার পর তিনি এ কথা জানতে পাড়েন যে, আদৌ কোনও রূশীয়
ব্যাক্তি ওই মঠ পরিদর্শন করতে কখনো আসেনি, এমন কোনও ব্যাক্তিও আসেনি যার পা ভেঙে যাওয়ার
পর তাকে সুস্থ করে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছিল, এবং তার চাইতেও বড়ো কথা হল ওই ‘ইসা
নবী’ সম্বন্ধে লেখা কোন পুঁথি আদৌ তাদের মঠে নেই, কোন কালে ছিলও না। এই পুরো বিষয়টা
ওই মহিলাকে রীতিমতো হতভম্ব করে দিয়েছিল। ঠিক এর পরের বছর, আর্চিবাল্ড ডৌগলাস
(J. Archibald Douglas) নামের একজন পণ্ডিত গবেষক এই ঘটনার সত্যতা যাচাই
করবার জন্য ওই মঠ পরিদর্শন করতে ভারতের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে গিয়ে তিনি
সরাসরি সেই মঠের মঠাধ্যক্ষের সাথে কথা বলে ওনার সাক্ষাৎকার নেন, তাকে মঠাধ্যক্ষ স্পষ্ট
জানান যে, “বিগত পনেরো বছরের মঠের কর্মদায়িত্বে এমন কোনও ইউরোপীয় ভাঙা পা নিয়ে তাঁর কাছে
কখনো আসেনি, এমন কোন ব্যাক্তিকেও তিনি চেনেন না যাকে তিনি ইসা নামে কোন নবীর কথা তিব্বতীয়
ভাষায় পুঁথি থেকে পড়ে শুনিয়ে ছিলেন!”
মঠাধ্যক্ষ আরও জানান, তিনি ৪০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বৌদ্ধ লামা ছিলেন এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে
নিয়ে তিনি বিস্তর পড়াশুনা করেছেন কিন্তু যীশু খ্রীষ্টের অজানা জীবন নিয়ে লেখা কোন পুঁথি
বৌদ্ধ সাহিত্যে দূরের কথা, সম্পূর্ণ তিব্বতে কোথাও নেই। তখন আর্চিবাল্ড ডৌগলাস বুঝতে পাড়েন যে, যীশুর অজানা জীবন নিয়ে
লেখা বই “La vie inconnue de Jesus Christ” আসলে এক মিথ্যা ও কাল্পনিক এক রচনা। মানুষকে যীশুর খ্রীষ্টের সম্বন্ধে
বিভ্রান্ত করবার একটা নিম্নমানের প্রচেষ্টা। প্রশ্ন উঠে, কিছু মানুষ কেনই বা যীশু খ্রীষ্টকে
নিয়ে এমন ধরণের কাল্পনিক এবং অবাস্তব সব লেখালেখি করে? এসব করে তাদের কী লাভ? অল্প
কথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। যেমনটা আমি আগেই বলেছিলাম, প্রভু যীশুকে নিয়ে মানুষের
মধ্যে কৌতূহল আর রহস্যের সীমা নেই। সেই প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে আজকের এই আধুনিক
যুগেও মানুষের মধ্যে ওই ব্যাপারটা থেকেই গেছে। তবে মুশকিল হল এই যে, ইন্টারনেট আর কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তার সাহচর্যে আধুনিক যুগের মানুষের কাছে তথ্যের অভাব না থাকলেও, তথ্যের সত্যতা
ও উৎস প্রমাণ করবার উপায়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যে সকল বিষয়ে প্রমাণ (Evidence) কম
থাকে, সে সকল বিষয় নিয়ে মানুষ তত বেশী তত্ত্ব (Theory) রচনা করে। যাতে মানুষ তার
মনের মধ্যে জমে থাকা প্রশ্নের বোঝা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারে। মানুষের কাছে যখন
প্রমাণ থাকে না, তখন সে নিজের মনের মতো করে অনেক প্রমাণ তৈরি করে নেয়। আমরা প্রায়ই
দেখেছি যে ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিরা সমাজের চোখে নিজেদের সৎ প্রমাণ করবার জন্য তাদের কুকর্মের
আসল তথ্য-প্রমাণই যে শুধু লোপাট করে তা নয়, বরং অনেক মিথ্যা প্রমাণ তৈরি করে নেয়। যা
অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ সত্যি বলেই বিশ্বাস করে নেয়। ইংরেজিতে “The Big Lie
Technique” বলে একটা কথা আছে। এই কথার অর্থ হলঃ “যদি একটা বড়ো মিথ্যাকে মানুষের
কাছে অনবরত প্রচার করা যেতে পারে, এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ ওই মিথ্যাকে সত্যি বলেই
বিশ্বাস করে নেবে।” এরই একটা জীবন্ত প্রমাণ হল, যীশু খ্রীষ্টের ভারতে গিয়ে হিন্দুধর্ম
ও বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞান অর্জন করবার এই কাল্পনিক কাহিনী। তবে এই বিষয় নিয়ে আমরা যখন
গভীর আধ্যাত্মিক ভাবে চিন্তা করবো, তখন এটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না যে, এটা শয়তানের
কাজ। কারণ মঙ্গলসমাচারের বাণী সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ভাবে অবগত। তার পক্ষে খ্রীষ্টের
প্রকৃত ঐশ বাণীকে বিনষ্ট করা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই সে যীশু খ্রীষ্টের নামে অনেক মিথ্যা
মঙ্গলসমাচার জগতে প্রচার করতে যাচ্ছে। পবিত্র বাইবেল বহুকাল আগেই সে কথা খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের
জানিয়ে রেখেছে। যারা পবিত্র বাইবেল নিয়মিত পড়েন, তারা সকলেই এসব ব্যাপারে খুবই সচেতন।
যীশু খ্রীষ্টের ছেলাবেলা
কেটেছে নাজারেথে, তিনি ইস্রায়েলের বাইরে কখনো পা বাড়ান নি!
যীশু খ্রীষ্টের পুরো জীবনটাই
কেটেছে ইস্রায়েল দেশে। তিনি কোন দিনও তাঁর দেশের বাইরে অন্য কোথাও যাননি। এমনকি বাণী
প্রচার করবার জন্যও নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোনও দেশে যাত্রা করেননি। পবিত্র শাস্ত্র বাইবেল
থেকেই তার কয়েকটা প্রমাণ এখানে তুলে ধরছি। সেগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং প্রয়োজন হলে
সেগুলো কোথাও লিখে রাখুন।
“সেখানে তিনি নাজারেথে নামে এক শহরে গিয়ে বসবাস করতে লাগলেন। এমনটি ঘটলো, যাতে সত্য হয় প্রবক্তার মুখে উচ্চারিত এই ঐশ উক্তিঃ ‘তিনি নাজারীয় বলে অভিহিত হবেন’।” (মথি ২:২৩)
গ্রীকপাঠঃ
[καὶ ἐλθὼν κατῴκησεν εἰς πόλιν λεγομένην ναζαρέτ, ὅπως πληρωθῇ τὸ ῥηθὲν διὰ τῶν προφητῶν ὅτι ναζωραῖος κληθήσεται.]
“তারপর তিনি তাঁদের সঙ্গে নাজারেথে ফিরে গেলেন; সেখানে তিনি সব সময় তাঁদের বাধ্য হয়েই থাকতেন। তাঁর মা এই সমস্ত কথা নিজের অন্তরে গেঁথে রাখতেন।” (লুক ২:৫১)
গ্রীকপাঠঃ
[καὶ κατέβη μετ᾽ αὐτῶν καὶ ἦλθεν εἰς ναζαρέθ, καὶ ἦν ὑποτασσόμενος αὐτοῖς. καὶ ἡ μήτηρ αὐτοῦ διετήρει πάντα τὰ ῥήματα ἐν τῇ καρδίᾳ αὐτῆς.]
“তিনি এবার নাজারাথে এলেন, এই এখানে তিনি মানুষ হয়েছিলেন। তাঁর অভ্যাসমতো তিনি বিশ্রামবারে সমাজগৃহে গেলেন। সেখানে তিনি শাস্ত্র পাঠ করবার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন।” (লুক ৪:১৬)
গ্রীকপাঠঃ
[καὶ ἦλθεν εἰς ναζαρά, οὖ ἦν τεθραμμένος, καὶ εἰσῆλθεν κατὰ τὸ εἰωθὸς αὐτῶ ἐν τῇ ἡμέρᾳ τῶν σαββάτων εἰς τὴν συναγωγήν, καὶ ἀνέστη ἀναγνῶναι.]
সাধু মথি এবং সাধু লুকের লেখা মঙ্গলসমাচারে
আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, যীশুর ছেলেবেলা এবং বাকি জীবন কেটেছে ইস্রায়েল দেশের নাজারেথ
শহরে। ভৌগলিক ভাবে নাজারেথ শহরটি ইস্রায়েলের উত্তর রাজ্যের, যুদেয়ার গালালিয়া প্রদেশে
অবস্থিত। নাজারেথ শহরটি ইস্রায়েলের আরব রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। [ম্যাপে দেখার জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ Nazareth
- Google Maps]
প্রভু যীশু খ্রীষ্টের জন্ম হয় রাজা হেরদের আমলে, যুদেয়ার বেথলেহেম শহরে।
কিন্তু শিশু যীশুকে হত্যা করবার জন্য হেরদ যখন বেথলেহেমে লোক পাঠায়, তখন সাধু যোসেফ
ঈশ্বরের আদেশে কুমারী মারীয়া ও শিশু যীশুকে নিয়ে হিরদের মৃত্যু পর্যন্ত মিশর দেশে গিয়ে
বসবাস করতে থাকে। হেরদের মৃত্যুর পর তার পুত্র আর্খেলাউস পিতার সিংহাসনে বসে। সে সময়
সাধু যোসেফ, কুমারী মারীয়া আর শিশু যীশুকে নিয়ে ইস্রায়েল দেশে ফিরে আসার পর গালিলিয়ার
নাজারেথ শহরে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ওই নাজারেথ ছিল প্রভু যীশু, কুমারী
মারীয়া এবং সাধু যোসেফের চিরকালের ঠিকানা। তাই তো ইতিহাসের পাতায় তাঁদের কে “নাজারেথের
পবিত্র পরিবার” বা “The Holy Family Of Nazareth” নামেই ডাকা হয়।
লেখার শেষ প্রান্তে এসে কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। যীশু খ্রীষ্টের
ছেলেবেলা ঠিক কেমন ছিল, কেমন ভাবে কেটেছিল তাঁর পার্থিব জীবনকাল, এ সবের খুঁটিনাটি
তথ্য দেওয়ার জন্য মঙ্গলসমাচার লেখা হয়নি। সাধু যোহন, যিনি প্রেরিত শিষ্যদের মধ্যে
যীশুর কাছে স্নেহের পাত্র ছিলেন, তিনি নিজেই আমাদের এ কথা জানিয়ে গেছেন যে, “যীশু খ্রীষ্ট জীবনে আরও অনেক কিছু করেছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে এমন
বহু বিষয় আছে যা বইয়ে লিখে রাখা সম্ভব হয়নি। সে সব বিষয় নিয়ে খুঁটিয়ে লিখতে গেলে যে
পরিমাণ বইপত্র জমা হবে, তা গোটা জগতেও ধরবে না…” (যোহন ২০:৩০, ২১:২৫)। মঙ্গলসমাচার লেখার প্রধান উদ্দেশ্যই
ছিল যীশু খ্রীষ্টের আসল পরিচয় মানুষের কাছে প্রকাশ করা। তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর! তিনিই এই
জগতের সৃষ্টিকর্তা ও বিচারক। মানুষের পরিত্রাণের জন্য মানুষরূপে স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ
হয়েছিলেন। তিনি মানুষের মাঝখানেই বাস করতেন। তাঁর জীবন যাপনের ধরণ ছিল অতি সাধারণ।
কিন্তু তাঁর কাজকর্ম ছিল অসাধারণ, মানুষের বোধগম্যের বাইরে। তিনি নিজের মধ্যে মানুষের
মনুষ্যত্ব এবং ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব কে এক করে দিয়েছেন। যাতে ঈশ্বর ও মানুষ একসাথে বসবাস
করতে পারে। তিনি নিজেকে মানুষের কাছে ততটাই প্রকাশ করেছেন, মানুষ নিজের মানবীয় সীমাবদ্ধতায়
ঠিক যতটা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তার পরেও কি সকল মানুষ যীশুকে প্রকৃত সনাতন ঈশ্বর
বলে চিনতে পেরেছে? না! সকলে তা পারেনি। তা পারলে বোধহয় আমাকে আজ এই লেখালিখি করতেই
হতো না। মানুষ যেখানে নিজের মতো আর এক মানুষকে চিনতে পারে না, সে ঈশ্বরকে কী ভাবে চিনবে?
কী ভাবে বুঝবে তাঁর রহস্য? কী ভাবে বুঝবে তাঁর সুক্ষ কাজকর্মের কারিগরি? এ সব কথা মন
দিয়ে ভাবতে হয়। জগতে অনেক মিথ্যার চাষ হচ্ছে। শয়তান তার সর্বনাশের কাজ অবিরাম করে যাচ্ছে।
মানুষকে মিথ্যার মধ্যে থেকে সত্যিটা খুঁজে বার করে নিতে হবে। আর সত্য একমাত্র যীশু।
তিনি ছাড়া আর কেউ নয়। অখ্রীষ্টান হিন্দু পরিবারে বড়ো হয়েও ঈশ্বরের সন্ধান আমি কোনও
দিনই পাইনি। অবশ্য ঈশ্বরের নামে চালানো অনেক তত্ত্বকথা আর কাল্পনিক সব গল্প পেয়েছি।
কিন্তু তাঁদের কেউই যীশু খ্রীষ্টের মতো বাস্তব চরিত্র নয়। তাঁরা সকলেই মানুষ সৃষ্ট
কাল্পনিক দেবতা মাত্র। যীশু খ্রীষ্টের সম্বন্ধে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা
ও বিশ্বাস আছে। তারা নিজেরা ওই যা কিছু বিশ্বাস করে, আবার অন্যদের কাছেও সে সব কথা
প্রচার করে। এমনটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু আমার মতো যারা সত্যকে জানবার জন্য
যীশু খ্রীষ্টের ব্যাপারে লেখা ইতিহাস নিয়ে পড়েছেন, আর পড়েছেন মঙ্গলসমাচার, তারা সকলেই
পরে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। কারণ অখ্রীষ্টান বিধর্মীরা যীশু খ্রীষ্টের সম্বন্ধে
শত শত মিথ্যা প্রচার করে। আপনি যদি প্রভু যীশুর সম্বন্ধে সঠিক ভাবে জানতে ও তথ্য পেতে
চান, তাহলে বাইবেল পড়ুন। বিধর্মীদের লেখা কাল্পনিক বই পড়বেন না।
তারপর তিনি তাঁদের বললেনঃ “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও; বিশ্বসৃষ্টির কাছে তোমরা ঘোষণা করো মঙ্গলসমাচার! যে বিশ্বাস করবে আর দিক্ষাস্নাত হবে, সে পরিত্রাণ পাবে। যে বিশ্বাস করবে না, সে কিন্তু শাস্তিই পাবে।” (মার্ক ১৬:১৫-১৬)
তথ্যসূত্রঃ
১. Per Beskow, Strange Tales about Jesus: A Survey of Unfamiliar Gospels (Philadelphia: Fortress Press, 1983) 57-65.
২. Louis H. Fader, The Issa Tale That Will Not Die: Nicholas
Notovitch and His Fraudulent Gospel (2023)
৩. Edgar J. Goodspeed, Strange New Gospels, Chicago: University
of Chicago Press (1931), v+110pp.
৪. https://www.tertullian.org/articles/goodspeed_strange_new_gospels.htm