আমি খ্রীষ্টান। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী
আস্তিক মানুষ। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক; এই সবকিছুতেই আমি বিশ্বাস রাখি। এবং
তার সাথে যুক্তিতর্ক, বিচার-বিশ্লেষণ, সত্য-মিথ্যা, বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান; এসবেও ভরসা রাখি। আমি তাদের
অপছন্দ করি যারা শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক কিংবা বিজ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণ দ্বারাই সবকিছুকে
ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করে। তেমন বিচার পক্ষপাতদুষ্ট বিচার। শুধুমাত্র বিজ্ঞান কোনো
কথা বলেছে বলেই যে সেটা একেবারে খাঁটি ও সত্য, সেটাকে চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে, আর
ধর্ম কোনো কথা বলছে মানেই যে সেটা অসত্য, হাস্যকর, কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসে ঘেরা,
তাই সেটা অগ্রাহ্য করতে হবে; সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। আর তারাও এমনটা বিশ্বাস করেন
না, যারা প্রকৃত অর্থে যুক্তিবিদ্যা, বিচার বিশ্লেষণের মৌলিক নিয়মগুলি বোঝেন। যদি আমরা
বিজ্ঞানকে, তারই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও যুক্তি দ্বারা বিচার করতে যাই, তাহলে বিজ্ঞান নিজেই
ভুল প্রমাণিত হবে। অঙ্ক এবং যুক্তিবিদ্যার বেলাতেও ঐ একই ঘটনা ঘটবে। যারা নিজেদের যুক্তিবাদী
নাস্তিক বলে বিশ্বাস ক’রে, তারা ঠিক যে ভাবে ধর্মীয় বিষয় ও আধ্যাত্মিকতাকে বিভিন্ন
দিক দিয়ে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, তারা কী ঐ একই ভাবে বিজ্ঞান ও যুক্তিকেও বিভিন্ন
প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে কী? আমি আজও অবধি আমার জীবনে তেমন কোনও যুক্তিবাদী ও নাস্তিক
দেখিনি। হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমি যা দেখতে পেয়েছি, তা হলো ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার
প্রতি নাস্তিকদের ঘৃণায় ভরা ব্যাক্তিগত আক্রমণ, তামাশাপূর্ণ ও অসম্মানজনক বাক্যপ্রয়োগ।
এ ভাবে কী তারা কখনো ধর্মকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারবে? এতে কী তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে
অসত্য বলে মানুষের কাছে প্রমাণ করতে পারবে?
প্রতিটি বিষয়ের (Subject) নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাদের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী আছে। প্রতিটি বিষয় তার নিজের স্বভাব অনুসারে
জগতকে ব্যাখ্যা করে। যেমন ধরুন সাহিত্য। সাহিত্য বলতে, যে কোনও সাধারণত বিষয়কে লিখিতরুপে
অসামান্য ও সুন্দর ভাবে প্রকাশ করাকেই বোঝায়। একজন সাহিত্যিক হতে গেলে একজন মানুষকে
প্রধানত ‘ষষ্ট ইন্দ্রিয়ের’ উপরেই নির্ভরশীল হতে হয়। অর্থাৎ, তাকে চিন্তা, আবেগ ও অনুভূতি
দিয়েই তার চারপাশটাকে অন্তর দিয়ে বুঝতে হয়। কঠোর যুক্তি কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণা সে
ব্যাবহার করে না। এবার ধরুন একজন ব্যাক্তি, যিনি গণিতবিদ্যা নিয়ে চর্চা, যিনি গাণিতিক
পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে জগৎসংসারকে ব্যাখ্যা করেন, তার কাছে সাহিত্য নামের এই বস্তুটা
নিতান্তই হাস্যকর এবং অপ্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। কারণ তার কাছে সাহিত্যের কোনো মূল্য
নেই। অথচ সাহিত্য ছাড়া আমাদের সমাজ চলবে না, মানুষ চিন্তাশীল ও রুচিবাগীশ হয়ে উঠবে
না। আসল সমস্যার সৃষ্টি তখনই হয়, যখন মানুষ একটা বিষয় দিয়ে অন্য আরেকটা বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ
এবং ব্যাখ্যা দ্বারা তার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা বিচার করতে বসে। এখন কেউ যদি বিজ্ঞান
দ্বারা সাহিত্যকে বিচার করতে যায়, তাহলে সাহিত্য তার কাছে ভুল বলেই মনে হবে। আবার অন্যদিকে
কেউ যদি সাহিত্য দ্বারা চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে বিচার করতে যায়, তবে সেটাও অর্থহীন বলে প্রমাণিত
হবে। একজন খাঁটি শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ প্রতিটি বিষয়কে তার মতো করেই গ্রহণ করেন, অন্য
কোনও ভাবে নয়। তাই ধর্মকে, ধর্মের মতো করেই গ্রহণ করতে হবে, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা মতো
নয়। আবার বিজ্ঞানকে, বিজ্ঞানের মতো করেই গ্রহণ করতে হবে, ধর্মের ব্যাখ্যা মতো নয়। মানুষের
জীবনে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভূমিকা আলাদা আলদা। এই দুটি বিষয়কে একই মাপকাঠিতে বিচার করাটা
একটি সাংঘাতিক ভুল। যারা এ বিষয় নিয়ে তর্ক করতে ভালবাসেন তারা আসলেই অজ্ঞ। তারা মানবজীবনের
আদিম প্রয়োজনীয়তাগুলি বোঝেন না। তারা এ কথা বোঝেন না যে, মানুষ নিজেই নিজের কাছে একটা
রহস্য! মানুষ নিজেই ঠিকমতো জানে না সে আসলে কে, সে আসলে কি চায়, আর কেনই বা সে তা চায়।
এই সব নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা শুরু করলে মানুষ নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, ধর্ম আর
বিজ্ঞান, তারা প্রকৃতপক্ষে পরস্পর বিরোধী নয়। তারা দুজনেই ঈশ্বরের আপন প্রকাশভঙ্গী।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে আদৌ কোনও বিরোধিতা নেই। যারা তেমনটা মনে করেন, তারা ধর্মও বোঝেন
না, বিজ্ঞানও বোঝেন না। তারা আসলে একটিকে অন্যটির বিরুদ্ধে হাতিয়ার রূপে ব্যাবহার করেন
কিংবা একটিকে অন্যটির চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। লোহা এবং সোনা, এ দুটোই ধাতু। এখন
এ দুটোর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, সেটা বিচার করতে গেলে নিজেকেই মূর্খ বলে প্রমাণ করতে হয়।
লোহা মানুষের জীবনে যে কাজে লাগে, সোনা দিয়ে মানুষ কী সেই একই কাজ করে? মানুষের জীবনে
লোহা আর সোনার ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা কী এক? আর কত বুঝিয়ে বলবো? আজকাল মানুষ চিন্তা
করে কম, আর বকে বেশী। অবশ্য দুঃশ্চিন্তা করে নিজেদের স্বাস্থের বারোটা বাজাতে মোটামুটি
সব মানুষই পারে।
ঈশ্বর নিজেকে ও তাঁর সৃষ্টি সমস্ত
জগত সংসারকে, ধর্ম ও বিজ্ঞান, এই দুটি বিষয় দ্বারা প্রকাশ করেছেন। ধর্ম - বিশ্বাস,
আস্থা ও আধ্যাত্মিকতা দ্বারা মানুষের কাছে সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়, জগতের বিভিন্ন রহস্যের
সমধান করে থাকে। অন্যদিকে বিজ্ঞান - গবেষণা, যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা
মানুষের অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দেয়, যা ধর্ম ব্যাখ্যা করতে পারে না। একজন প্রকৃত
জ্ঞানী ব্যাক্তি, ধর্ম ও বিজ্ঞান, দুটিকেই সমাদর করে। একটাকে হেয় করে অন্যটাকে সম্মান
ক’রে না। তবে এ কথা সত্যি যে, ধর্ম ও বিজ্ঞান, এ দুটি ক্ষেত্রেই অনেক দুর্নীতি, অনেক
ভেজাল আছে। এ দুটি ক্ষেত্রেই সৎ অসৎ মানুষের অভাব নেই। কারণ মানুষ যেখানেই আছে, সেখানেই
অন্যায় আছে। ভালও আছে, আবার মন্দও আছে। স্বভাব দুর্বল মানুষ যেখানেই থাকবে, তার স্বাভাব
অনুযায়ী নিম্নমানের কাজকর্ম করবেই। এই সত্যিটা মাথা পেতে স্বীকার করা ছাড়া আর আমাদের
অন্য কোনও উপায় নেই। যে সকল ব্যাক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, যারা যুক্তিবাদী
ও বিজ্ঞানমনস্ক, তারা সকলেই যে সৎ এবং নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এমন কোনও জোরালো প্রমাণ
পৃথিবীর কোনও নাস্তিক দিতে পারবে না। একজন মানুষ বিজ্ঞান মানে বলেই যে সে সঠিক ধারার
মানুষ, এ কথা আমি মানি না। অথচ ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষরা যখন কোনও ভুল করে, কোনও অন্যায়
করে বসে, তখন যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষগুলো রেরে করে তেড়ে আসে, আর তার ধর্মের
তুলোধোনা করতে শুরু করে। যেন তার অপকর্মের জন্য দায়ী তার ধর্মীয় বিশ্বাস। দুজন ব্যাক্তির
তুলনা করা যাক। একজন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে আর অন্যজন নাস্তিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। দুজনেই
একটা দোকান থেকে কিছু জিনিস চুরি করেছে। এখন নৈতিক বিচারের দিক দিয়ে এই দুজনের মধ্যে
কার চুরি করাটা বড় অপরাধ বলে গণ্য হবে? যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, সে? নাকি যে নাস্তিক,
যে বিজ্ঞানে বিশ্বাস রাখে? এর সঠিক উত্তরটা না হয় আপনি নিজেই ভাবনা চিন্তা করে বের
করুন। নাস্তিক বা বিজ্ঞান মেনে চলা ব্যাক্তিদের ধারণা, যদি কোনও মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস
রাখে, বা ধার্মিক হয়, তাহলে তার দ্বারা ভুল হওয়া মানেই সেটা তার ধর্মের ব্যর্থতা বা
ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যর্থতা! এর অর্থ দাঁড়ালো, একজন মানুষের খারাপ কাজকর্ম, সে কিসে বিশ্বাস
করে, সে কী মানে, তা প্রতিফলিত করে। এমনটাই যদি ব্যাপার হয়, তবে তো বিজ্ঞানকেও আরও
বেশী করে অবিশ্বাস করতে হয়, তাকে খারাপ বলতে হয়। কারণ বিজ্ঞান পরামাণু বোমার
মতো একটি ধ্বংসাত্মক জিনিস তৈরি করেছে যা ব্যাবহার করে চোখের নিমেষেই একটা গোটা দেশকে
পৃথিবীর মানচিত্র চিরকালের জন্য মুছে ফেলা যায়। যিনি পরামাণু বোমা আবিষ্কার করেছিলেন,
তাঁর নাম জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার (১৯০৪-১৯৬৭)। ইতিহাস তাকে “পরামাণু বোমার জনক”
বা “Father of the atomic bomb” নামেই আখ্যা দেয়। রবার্ট ওপেনহাইমার “দ্য
মানহ্যাটান প্রোজেক্ট” নামের একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই গবেষণার মুখ্য
উদ্দেশ্যই ছিল পারমাণবিক শক্তি নিয়ে। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একশো জনেরও বেশী
পদার্থবিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার। পরবর্তীতে এই পারামাণু বোমা আবিষ্কারের কী পরিণাম হয়েছিল
আমরা তা জানি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলছে। ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দের ৬ এবং
৯ই আগস্ট, আমেরিকা জাপানের দুটি শহর ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’র উপর আকাশ
পথে বোমা বাহক উড়োজাহাজ B-29 Bomber কে দিয়ে পরামাণু বোমা নিক্ষেপ করে। এই পারমাণবিক
বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষাধিক মানুষ ঝলসে মারা যায়। প্রথম বিস্ফোরণে আনুমানিক
১২৯,০০০ এবং দ্বিতীয় বিস্ফোরণে ২২৬,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়! এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের মারাত্মক
কুপ্রভাব দেখা দিয়েছিল, ওই দুটি শহরে পরবর্তী সময়ে বহু শিশু শারীরিক ও মানসিক ভাবে
বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। বর্তমানে পরামাণু বোমার চাইতেও অত্যাধুনিক ও অধিক ক্ষমতাশালী
বোমা আবিষ্কার করেছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। শুধুমাত্র বোমাই নয়, বিজ্ঞানের দৌলতে আধুনিক
যুগের সমস্ত রকমের মানুষ মারবার কারিগরি যন্ত্র ও অস্ত্র মানুষের হাতে এসে পৌঁছেচে।
কিন্তু কোনও নাস্তিক ও বিজ্ঞান
অনুরাগী লোকজন কিন্তু বিজ্ঞানের তৈরি ওই সব মানুষ মারার যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্রের
ব্যাপারে সমালোচনা বা নিন্দা করবে না। তারা এ কথাও বলবে না যে, বিজ্ঞান খারাপ কাজ করছে,
কারণ এটা মানুষের হাতে মানুষকে বিনাশ করবার উপায় তুলে দিয়েছে। তারা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের
কাউকেই দোষারোপ করবে না। কারণ বিজ্ঞানের নামে পৃথিবী ধ্বংস হলেও সেটা কিন্তু তাদের
কাছে কোনও অপরাধের বিষয় নয়। আসলে বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো ভুল থাকতেই পারে না। তারা বরং
ধর্মের খুঁত খুঁজে বেড়াবে।
“মানবজাতি পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করেছে, কিন্তু কোনও ইঁদুর কখনো নিজের জন্য ফাঁদ তৈরি করবে না।” - আলবার্ট আইনস্টাইন
খ্রীষ্টধর্মে বলা হয়েছে, জ্ঞান
অর্জন করবার আগে একজন মানুষকে চরিত্রবান হয়ে ওঠার প্রয়োজন। তার মধ্যে থাকতে হবে বিবেকের
ডাক ও নৈতিকতার সঠিক মূল্যবোধ। যদি একজন ব্যাক্তি চরিত্র ও নৈতিকতার দিক দিয়ে সৎ এবং
ভালো মানুষ না হয়, তবে সে যে জ্ঞানই অর্জন করবে, তা দিয়ে সে অপকর্ম করবে। Without
goodness, knowledge is not good. তাই পণ্ডিত ব্যাক্তি মানেই যে সে জ্ঞানী, সে শিক্ষিত,
এমনটা ভাবা উচিত নয়। অনেক বইপত্র পড়েছে, অনেকগুলো ডিগ্রি আছে বলেই যে ওই মানুষটা শিক্ষিত,
এই চিন্তাটাই আসলে ভুল। শিক্ষিত হওয়ার অর্থ মোটা মোটা বই পড়া নয়, বা কোন বিষয়ের উপরে
প্রচুর জ্ঞান অর্জন করাও নয়। শিক্ষিত হওয়ার প্রকৃত অর্থ হল, যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছি,
সেটা আমি কত প্রক্রিয়াশীল ও গঠনমূলক ভাবে মানুষ ও সমাজের কল্যাণের ব্যবহার করতে পারি।
শিক্ষিত হওয়া মানে, সমস্ত বিষয়কে সুন্দরভাবে অন্তর ও বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার ক্ষমতা। আপনার
চারপাশে তথাকথিত ওমন বহু শিক্ষিত মানুষের দেখা পাবেন, যারা নিজের স্ত্রী কে ধরে পেটায়,
নিজেদের সন্তানদের সাথে অমানুষিক আচরণ করে, রিস্কাওয়ালা আর বাজারওয়ালার সাথে খিস্তি-গালাগাল
দিয়ে কথা বলে। আবার তেমন মানুষের সন্ধানও পাবেন, যারা স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি, অথচ তাদের
কথাবার্তা শুনলে মনে হয় একজন শিক্ষিত ব্যাক্তি কথা বলছেন। মানুষের জ্ঞান তার চরিত্রের
পরিচয় নয়, বরং মানুষের চরিত্রই তার জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। জীবনে এ পর্যন্ত যত মানুষের
সাথে আমি মেলামেশা করেছি, তাদের মধ্যে আমি তাদেরই মনে রেখেছি যারা আমার সাথে ভালো আচরণ
করেছিলেন। তাই আমি আগেই বলেছিলাম, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানেই যে সে সঠিক মানুষ,
এমনটা আমি কোনদিনও বিশ্বাস করবো না। আমরা মানুষ হিসেবে এ পর্যন্ত যা কিছু জানি, তা
সবই অসম্পূর্ণ। আর অসম্পূর্ণ বলেই বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আমরা এই জগতটাকে দেখি। ঈশ্বর
বিশ্বাস মানুষকে সেই অসম্পূর্ণ, সেই অজানা জ্ঞানের সন্ধান দেয় যা মানুষ নিজের যুক্তিগত
বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা জানতে পারে না। আমরা মানুষের অর্জিত জ্ঞানকে চারটি
শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারিঃ
১) আমরা যা জানি।
২) আমরা যা জানি বলে মনে
করি, কিন্তু তা আসলে জানি না।
৩) আমরা এখনও যা জানি না।
৪) আমরা যা কখনই জানতে পারব
না।
এই জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যার
সঠিক উত্তর বিজ্ঞান কখনই দিতে পারবে না। বিজ্ঞান নিজেও সে কথা স্বীকার করে । বিজ্ঞান
প্রমাণ নির্ভর। প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞান কোনকিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করে না। এ বিশ্বসংসারে
এমন অনেক সত্য আছে যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আর তাই বিজ্ঞান সে সকল বিষয় নিয়ে জোর দিয়ে
কোনও কথা বলে না। বিজ্ঞান আজও পর্যন্ত কিন্তু একথা বলেনি যে, “ঈশ্বর বলে কেউই নেই!”।
কারণ এই কথা বলতে গেলে বিজ্ঞানকে পৃথিবীর মানুষের কাছে একটা জোরালো ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ
তুলে ধরতে হবে। তেমন কোনও প্রমাণ কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে নেই। আবার কেউ যদি এ কথা মনে
করে, যুক্তি-পদ্ধতি দিয়ে মানুষ তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে, জগতের সমস্ত রহস্যের
সমাধান ঘটাবে, তবে সে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কুর্ট ফ্রেড্রিক গ্যোডেল, যিনি ছিলেন
অস্ট্রীয়-মার্কিন যুক্তিবিদ, গণিতবিদ ও গণিতের দার্শনিক; তিনি তাঁর গবেষণায় প্রমাণ
করে গছেন যে, পৃথিবীতে এমন কোনও যুক্তিবিদ্যা নেই যা মানুষকে তার সমস্ত প্রশ্নের সঠিক
উত্তর দিতে পারে। যুক্তির একটা সীমাবদ্ধতা। মানুষের জানবারও একটা সীমা আছে। মানুষ নিজে
যা কিছু জানে বলে বিশ্বাস করে, তার মধ্যেও আবার অনেক খামতি, অনেক পক্ষপাত আছে। এই জগতের
সবকিছুই যদি বিজ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা যেত, তবে মানুষ মন, আবেগ, অনুভূতি
ও চেতনার উপর ভরসা কোনদিনও করতো না। মানুষ এ কারণেই মানুষ। আমি এ কথা বিশ্বাস করি না
যে, বিজ্ঞান একদিন মানুষের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে। তবে আমি বিশ্বাস করি যে, এমন
এক সময় আসবে যখন বিজ্ঞান নিজেই মানুষের সামনে একটা জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে যে,
ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, এবং ধর্মের প্রয়োজন আছে। ঈশ্বর ছাড়া এই জগতের কোনও অর্থ নেই।
সত্যও নেই, মিথ্যাও নেই। সবই আসলে অর্থহীন।
“ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।” - আলবার্ট আইনস্টাইন