পবিত্র রোজারী জপমালা (The Holy Rosary) এক বিশেষ ধরণের পরাক্রমি প্রার্থনা এবং এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন। এই বিশেষ প্রার্থনার মাধ্যমে একজন বিশ্বাসী “খ্রীষ্টধর্মের মৌলিক বিশ্বাস ও প্রধান ধর্মতত্ত্বগুলি” কে উচ্চারণ করে প্রার্থনা ক’রে। খ্রীষ্টের স্থাপিত পৈরিত্তিক ক্যাথলিক মণ্ডলীতে বহুকাল থেকেই এই প্রার্থনাটি ভক্তিপ্রাণ খ্রীষ্টানদের কাছে সমাদৃত এবং তাদের খ্রীষ্টীয় জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখা যায়। যুগ যুগ ধরে এই বিশেষ জপমালা প্রার্থনার মাধ্যমে অগণিত অলৌকিক ঘটনা, রোগ নিরাময় ও সুস্থতা, পাপীদের মন পরিবর্তন, খ্রীষ্ট শত্রুদের পরাজয় এবং অবিশ্বাসীদের কাছে প্রভু যীশুর পরিত্রাণের মঙ্গলসমাচার প্রচারের মতো নানা ঘটনার সাক্ষী থেকেছে আমাদের পবিত্র খ্রীষ্টমণ্ডলী। খ্রীষ্টমণ্ডলীতে পবিত্র রোজারী জপমালার ইতিহাস এতটাই সুগভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ যে, যা এখানে বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু আজ দেখা যায় অনেক খ্রীষ্টান পবিত্র রোজারী জপমালাকে নিজেরদের জীবনে কোনও স্থানই দিচ্ছে না। তাদের কাছে এটা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। কেউ কেউ আবার মনে করে পবিত্র রোজারী জপমালা বাইবেল-কেন্দ্রিক নয়, বরং মানুষ রচিত এক অনুশীলন, তাই তারা একে মূল্যহীন ভেবে অস্বীকার করে! বলাই বাহুল্য, সঠিক খ্রীষ্টীয় ধর্মশিক্ষার অভাব, প্রটেস্টান্ট চার্চের অপপ্রচার এবং খ্রীষ্টমণ্ডলীতে রোজারী জপমালার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকার কারণে অনেক খ্রীষ্টবিশ্বাসী মানুষ সত্য থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। ওমন খ্রীষ্টান ব্যাক্তিরা এ কথা জানে না যে, পবিত্র রোজারী জপমালা বহুকাল কাল থেকেই মানবজাতির শত্রু শয়তান ও তার নরকের পিশাচ বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী আত্মিক অস্ত্র হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বর্গ-মর্তের সৃষ্টিকর্তা প্রভু, সেই মঙ্গলময় ঈশ্বর, সকল প্রকারের অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য এবং শয়তান ও খ্রীষ্টবিশ্বাস বিরোধী সকল শক্তিকে পরাজিত ক’রে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে, চিরকালের পরমধন্যা কুমারী মারীয়ার মাধ্যমে পবিত্র রোজারী জপমালাকে তাঁর পবিত্র খ্রীষ্ট মণ্ডলীকে শেষ দিনগুলির আধ্যাত্মিক অস্ত্র হিসেবে দান করেছেন এবং খ্রীষ্টানরা যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে এই বিশেষ প্রার্থনা করে, তার আদেশ দিয়েছেন।
খ্রীষ্টমণ্ডলীর ইতিহাস ও পরম্পরাগত
পুরনো দলিল থেকে এ কথা জানা যায় যে, ১২১৩ খ্রীষ্টাব্দে যীশু খ্রীষ্টের মা, পরমধন্যা
কুমারী মারীয়া ফ্রান্সের সাধু ডমিনিক দ্য গুউইমান (Dominic de Guzmán) কে দেখা দেন এবং তাঁর হাতে পবিত্র রোজারী জপমালা তুলে দেন। তার সাথে এই প্রার্থনার
বিশেষ কার্যকারিতা, এর গভীর আত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁকে প্রয়োজনীয় সমস্ত স্বর্গীয়
জ্ঞান দান করেছিলেন। সেই সময়ে ক্যাথলিক মণ্ডলী একটি ধর্মদ্রোহিতার (Heresy) সাথে লড়াই করছিল। ইতিহাসের পাতায়
যা “অ্যালবিজেনসিয়ান ধর্মদ্রোহিতার” (Albigensians Heresy) নামেই পরিচিত।
এই ধর্মমত অনুযায়ী সমস্ত অদৃশ্য আত্মিক (Spiritual) বিষয় ভালো এবং সমস্ত দৃশ্যমান জাগতিক
(Meterial) বিষয় মন্দ। অতএব খ্রীষ্টধর্মও মন্দ, কারণ ঈশ্বর কখনো মানুষ হয়ে জন্মাতে
পারে না, যেহেতু মানুষ মন্দ! এছাড়াও এই ধর্মমতের অনুগামীরা বিশ্বাস করতো যে, মানুষের
শরীর, মানুষের বিবাহ করা ও সন্তানের জন্ম দেওয়া, ব্যাক্তিগত সম্পত্তির মালিক হওয়া এবং
মাংস খাওয়া, এ সবই চূড়ান্ত ভাবে মন্দ বিষয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই ধর্মমতের বিশ্বাসগুলি
ঈশ্বরের আদেশ নয়, পবিত্র শাস্ত্র বাইবেলেও এমন ধরণের কথা কোথাও উল্লেখ করা নেই। বরং
পবিত্র শাস্ত্রে এই বিষয়ে সাধু পল বহুকাল আগেই আমাদের সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলে গেছেনঃ
“পবিত্র আত্মা স্পষ্টই বলেছেন যে, শেষের দিনগুলিতে কেউ কেউ খ্রীষ্টবিশ্বাসের পথ থেকে সরে যাবে। তারা ছল ভরা যত আত্মিক শক্তির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে শয়তানীয় নানা মতবাদ মেনে নেবে। যারা তেমন প্রচার করে বেড়াবে, তারা তো ভণ্ড, মিথ্যাবাদী মানুষ। তাদের বিবেক যেন জ্বলন্ত লোহার শিক দিয়ে দাসত্ব-চিহ্নেই চিহ্নিত। তারা সবাইকে বিয়ে করতে নিষেধ করবে এবং তেমন নানা খাবার খেতেও নিষেধ করে দেবে, ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেছেন যাতে, যাদের মনে তাঁর প্রতি বিশ্বাস আছে, যারা সত্যকে জানতে পেরেছে, তারা যেন তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওইসব খাবার গ্রহণ করে। ঈশ্বর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা তো ভালোই। তাই কোন খাবারই বর্জনীয় নয়; শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েই তা গ্রহণ করা উচিত।” (১ তিমথি ৪:১-৪)
এই “অ্যালবিজেনসিয়ান ধর্মদ্রোহিতার”
কারণে সত্যিই অনেক মানুষ খ্রীষ্টের পথ ছেড়ে দিয়েছিল এবং বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করে
দিয়ে পরিত্রাণের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। তাই এই শয়তানীয় মতবাদকে পুরোপুরি উচ্ছেদ
করতে এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের মতবাদের সাথে লড়াই করতে খ্রীষ্টমণ্ডলীতে রোজারী জপমালা
প্রার্থনার সূচনা হল। এই রোজারী জপমালার প্রার্থনার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে অনেক ঐশ আশীর্বাদ
ও অনুগ্রহ। পরমধন্যা কুমারী মারীয়া সাধু ডমিনিক কে বলেছেন, যারা প্রতিদিন বিশ্বাস ও
ভক্তি সহকারে পবিত্র রোজারী জপমালার প্রার্থনা করবে, তিনি তাদের জীবনে ১৫টি প্রতিশ্রুতি
পূর্ণ করবেন যা তিনি স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন। সেই ১৫টি প্রতিশ্রুতি এখানে উল্লেখ
করা হল।
✝ সাধু ডমিনিকের কাছে ধন্যা কুমারী মারীয়ার দ্বারা প্রকাশিত
রোজারী জপমালা প্রার্থনার ১৫টি প্রতিশ্রুতি ✝
১) যে ব্যক্তি বিশ্বস্তভাবে
রোজারী জপমালার প্রার্থনা দ্বারা আমার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করবে, সে বিশেষ অনুগ্রহ
পাবে।
২) আমি আমার বিশেষ সুরক্ষা
এবং সেই সকলের কাছে মহান অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যারা রোজারী জপমালার প্রার্থনা
করবে।
৩) রোজারী জপমালা নরকের বিরুদ্ধে
একটি শক্তিশালী ঢাল। এটা দুষ্টতা ধ্বংস করবে, পাপ হ্রাস করবে এবং খ্রীষ্টধর্ম বিরোধীদের
পরাজিত করবে।
৪) রোজারী জপমালা পুণ্য এবং
সৎকর্মের বিকাশ ঘটাবে। এটি আত্মার জন্য ঈশ্বরের অফুরন্ত করুণা এনে দেবে। জাগতিক ভালবাসা
এবং এর অসারতা থেকে মানুষের হৃদয়কে সরিয়ে দিয়ে তাকে ঈশ্বরকেন্দ্রিক করে তুলবে এবং
তাদের হৃদয়কে শ্বাশত স্বর্গীয় আকাঙ্ক্ষায় ভরিয়ে দেবে। মানুষ এই উপায়ে নিজেকে পবিত্র
করে তুলবে।
৫) যে ব্যক্তি রোজারী জপমালার
প্রার্থনা দ্বারা নিজেকে আমার কাছে সুপারিশ করবে, তার বিনাশ হবে না।
৬) যে ব্যক্তি ভক্তিসহকারে
রোজারী জপমালার প্রার্থনা করবে ও তার পবিত্র রহস্যগুলি ধ্যান করবে, সে কখনই জীবনের
দুর্ভাগ্য দ্বারা পরাজিত হবে না। ঈশ্বর তাঁর ন্যায়বিচারে তাকে শাস্তি দেবেন না। সে
ব্যক্তি হটাৎ মৃত্যুতে বিনষ্ট হবেন না; যদি সে ন্যায়বান হয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহে স্থির
থাকে, তবে সে অনন্ত জীবনের যোগ্য হয়ে উঠবে।
৭) যারা ভক্তিসহকারে রোজারী
জপমালার প্রার্থনা করবে, তারা পবিত্র খ্রীষ্টমন্ডলীর সংস্কারগুলি না পেয়ে মারা যাবে
না।
৮) যারা রোজারী জপমালার প্রার্থনা
করতে বিশ্বস্ত থাকবে, তারা তাদের জীবনকালে এবং তাদের মৃত্যুতে ঈশ্বরের আলো ও তাঁর মহিমার
প্রাচুর্য লাভ করবে। মৃত্যুর মুহুর্তে তারা স্বর্গের সাধুসাধীদের মেধার অংশীদার হয়ে
উঠবে।
৯) আমি বিলম্ব না করেই শুচাগ্নি
স্থান থেকে তাদের আত্মাদের উদ্ধার করে আনবো, যারা জীবনকালে রোজারী জপমালার প্রার্থনার
প্রতি বিশ্বস্ত ছিল।
১০) রোজারী জপমালার বিশ্বস্ত
সন্তানেরা স্বর্গে উচ্চমানের গৌরব লাভ করবে।
১১) রোজারী জপমালার প্রার্থনা
দ্বারা তুমি আমার কাছে যা চাইবে তা পাবে।
১২) যারা পবিত্র রোজারী জপমালার
প্রচার করবে, আমি তাদের সমস্ত প্রয়োজনে সাহায্য করবো।
১৩) আমি আমার ঐশ পুত্র যীশুর
কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছি যে, রোজারী জপমালার সমস্ত প্রচারক তাদের জীবনকালে এবং মৃত্যুর
সময়ে, ঐশরিক আদালতের মধ্যস্ত সাহায্য পাবে।
১৪) রোজারী জপমালার প্রার্থনা
করা সকলেই হলো আমার পুত্র ও কন্যা এবং আমার একমাত্র ঐশ পুত্র যীশু খ্রীষ্টের ভাই ও
বোন।
১৫) আমার রোজারী জপমালার
ভক্তি ভবিষ্যতের জন্য একটি মহান চিহ্ন।
সিস্টার লুসিয়া, যাকে কুমারী মারীয়া
১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগালের ফাতিমাতে স্বর্গীয় দর্শন দিয়েছিলেন, তিনি বলেছেনঃ
“আমরা বর্তমান সময়ে এই যে শেষের দিনগুলিতে বসবাস করছি, এই সময়ে ধন্যা কুমারী মারীয়া আমাদের রোজারী জপমালা প্রার্থনা করবার একটি নতুন কার্যকারিতা দিয়েছেন। তিনি এই কার্যকারিতাকে এমনই মাত্রা দিয়েছেন, যে এমন কোনও সমস্যা নেই, তা যত কঠিনই হোক না কেন, তা সাময়িক হোক বা সর্বোপরি আধ্যাত্মিক, আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনে হোক বা আমাদের পরিবারের মধ্যে… যা রোজারী জপমালার প্রার্থনা দ্বারা সমাধান করা যায় না! আবারও বলছি, এমন কোন সমস্যা নেই, তা যত কঠিনই হোক না কেন, যা আমরা পবিত্র রোজারী জপমালার প্রার্থনা দ্বারা সমাধান করতে পারি না।”
হ্যাঁ, রোজারী জপমালার প্রার্থনা দ্বারা একজন খ্রীষ্টান যে কোনও কঠিন সমস্যাকে সমধান করে দিতে পারে। যা কিছু মানুষের দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয়, যা কিছু মানুষের ক্ষমতার বাইরে, তেমন সব কিছুই পবিত্র রোজারী জপমালার প্রার্থনা দ্বারা করা সম্ভব। রোজারী জপমালা শয়তানের কাছে একটা আতঙ্ক! কিন্তু খ্রীষ্টানদের হাতে থাকা একটা শক্তিশালী বিজয় তলোয়ার। কারণ রোজারী জপমালার মধ্যে নিহিত আছে স্বয়ং খ্রীষ্টের আপন মহিমা এবং ঈশ্বরের হাতের শক্তি। আমি আশা করছি, এই নিবন্ধ আপনাকে প্রতিদিন পবিত্র রোজারী জপমালার প্রার্থনা করতে গভীর ভাবে উৎসাহ জোগাবে, খ্রীষ্টীয় বিশ্বাস আপনার জীবনে আরও দৃঢ়মূল হয়ে উঠবে, এবং তার সাথে ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রভু যীশুর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সকল জাতি ও বর্ণের মানুষের কাছে সেই চিরকালের সনাতন মঙ্গলবার্তা প্রচার করে তাদের কে দিক্ষাস্নানের দ্বারা পরিত্রাণের পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।