জ্ঞানী নানা প্রকারের হয়। এদের
আপনি অনেক জায়গায়, অনেক ভাবে এবং অনেক রূপে দেখে থাকবেন। এদের জ্ঞানের বহর দেখলে মাঝে
মাঝে এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, এরা এতো জানে, তবুও জ্ঞানের চাপে
ফেটে যায় না! কী আশ্চর্য ব্যাপার! তাদেরই একদল মানুষ আছে, যারা বলে থাকেঃ “বাইবেলে
অনেক বৈজ্ঞানিক ভুল আছে!”। এদের মধ্যে বেশীরভাগই নিজেরদের নাস্তিক, যুক্তিবাদী
কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক বলে দাবী করে। অথচ আদতে এরা কেউই কিন্তু নিজেরা কোনও বৈজ্ঞানিক
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নয়, এদের মধ্যে কেউই বিজ্ঞানীদের গবেষণা করবার পদ্ধতি ও নিয়মকানুন
জানে না। যে সমস্ত যুক্তি দিয়ে এরা ধর্ম ও ঈশ্বরকে ভুল প্রমাণ করবার হাতিয়ার হিসেবে
ব্যাবহার করে, সেই একই যুক্তি তারা নিজেদের বেলায়, নিজেদের ব্যাক্তিগত ধ্যানধারণা ও
বিশ্বাসের বেলায় খাটায় না। যদি নিজেদের বেলায় সে সব যুক্তি ব্যাবহার করে, তবে এরা যে
নিজেরাও ভুল প্রমাণিত হবে। এরা আসলে লোক দেখানো শিক্ষিত! এরা নিজেদের নাস্তিক, যুক্তিবাদী
কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক বলে দাবী করলেও, নিজেদের জীবনে ও নিজেদের স্বার্থে এরা কতটা বিজ্ঞান
আর কতটা যুক্তি মেনে চলে, তা মানুষজন ভালমতো জানে। কয়েকটা বইপত্র ঘেঁটে, ইন্টারনেটে
কতগুলো বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ পড়ে আর বিজ্ঞানীদের কিছু গবেষণা বা আবিষ্কারের কথা পড়ে
নিয়ে, নিজেদেরকে বিজ্ঞান বিশারদ মনে করতে থাকে। আর তা দিয়ে নিজেরা কি না কি বুঝে, সেটার
উপর ভিত্তি করেই তারা ধর্ম ও ঈশ্বরের নিন্দা করে। ধর্মকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।
একটা অবাক করা বিষয়, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানী এবং বৈজ্ঞানিক কোনও গবেষণার সঙ্গে
যুক্ত আছেন, তাদেরকে আপনি কখনই ধর্ম কিংবা ঈশ্বর নিন্দা করতে দেখতে পাবেন না। আসলে
যারা বিজ্ঞান বোঝে না, তারাই বেশী বিজ্ঞান বিজ্ঞান বলে লাফায়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছেঃ
“মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশী!”, এই কথাটা এদের ক্ষেত্রে খাটে।
এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। একটু
ভেবে উত্তর দেবেন। যখন আপনি কোন বই পড়েন, তখন সেই বইটা ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পড়েন?
যেমন ধরুন একটা গল্পের বই, যেটা আপনি মেলা থেকে কিনে এনেছেন বা হয়তো আমাজন বা ফ্লিপকার্ট
থেকে অনলাইনে কিনেছেন। মানে গল্পের বই পড়বার সময়ে আপনি কি সেটা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে
পড়েন? না কি গল্প পড়বার আনন্দে নিজেকে মনোরঞ্জন করবার জন্য পড়েন? যদি আমার আর আপনার
চিন্তা একই হয়, তবে আপনার উত্তর হবে, “গল্পের বইকে গল্পের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা উচিত!
নিজের মনকে সরল আনন্দ দেওয়ার জন্যই তো মানুষ গল্পের বই পড়ে”। আসলে ব্যাপারটা তাই। প্রতিটা
বইয়ের নিজস্ব বিষয় (Subject) রয়েছে। প্রতিটা বই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই
লেখা হয়ে থাকে। মানুষ যখন কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন চায়, বা সেই বিষয়ের
উপর পড়াশুনা করতে চায়; তখন তাকে কিন্তু সেই নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লেখা বই পড়তে হয়।
কেও যদি পদার্থবিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে চাইছে, সে অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানের
বই পড়বে। আবার কেউ যদি সাহিত্য নিয়ে চর্চা করতে চায়, তবে সে সাহিত্য সংক্রান্ত বইপত্র
পড়বে। কিন্তু যদি ধরুন এমনটা হল যে, একজন ব্যাক্তি পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়ছে যাতে সে
সাহিত্য চর্চা করতে পারে, আর সাহিত্যের বই পড়ছে যাতে সে পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করতে
পারে; এই পুরো বিষয়টি আপনি কী চোখে দেখবেন? আপনার কাছে এটা খুবই অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক
বলে মনে হবে, তাই না? আপনি হয়তো বলবেনঃ “লোকটার মাথায় নিশ্চয়ই কোনও গণ্ডগোল আছে!” অথচ
একদল লোক বলে থাকে, “বাইবেলে অনেক বৈজ্ঞানিক ভুল আছে!”। তাদের এই মন্তব্য আসলেই মুর্খামিপূর্ণ।
তার কারণ পবিত্র শাস্ত্র বাইবেলকে মানুষের কাছে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য অবতীর্ণ
করা হয়নি। মানবজাতিকে বাইবেল দেওয়া হয়েছে যাতে সে তার মাধ্যমে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক
শিক্ষা লাভ করতে পারে। যাতে মানুষ জানতে পারে এই জগতে তার অস্তিতের মূল কারণ কী, যাতে
সে জানতে পারে এই জগতের উৎপত্তি কী ভাবে হয়েছে এবং এর পিছনে স্রষ্টার উদ্দেশ্যটাই বা
কী! যাতে মানুষ ঈশ্বরকে জানতে পারে আর জানতে তিনি মানুষের কাছ থেকে কী চান।
যারা বাইবেলের মধ্যে বৈজ্ঞানিক
ভুল খুঁজে পান, তারা আসলে ভুল উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ভুল ভাবেই বাইবেল পড়ছেন। আপনি কেন
অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে এমন একটা বই পড়বেন, যে বইয়ের মূল উদ্দেশ্য আপনাকে বিপরীত অন্য
এক বিষয় জানাবার আছে? যদি আপনার উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে জানবারই থাকে, তাহলে
আপনি বিজ্ঞানেরই বই পড়ুন! খামোখা আপনি বাইবেল খুলে তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিষয় খুঁজতে
যাবেন কেন? তার মানে আপনি যখন কোন বিজ্ঞানের বই পড়েন, তার মধ্যে কী ধর্মীয় বিষয় খোঁজেন?
আর যদি তেমন কিছু না খুঁজে পান, আপনি কী তখন এ কথা বলেনঃ “বিজ্ঞানের বইয়ের মধ্যে অনেক
ধর্মীয় ভুল আছে”? যে সমস্ত মানুষ এই ধরণের কাজ করেন মনবিজ্ঞানের ভাষায় একে “জ্ঞানীয়
পক্ষপাত” বা Cognitive Bias বলা হয়ে থাকে। যখন একজন ব্যাক্তি নিজের যুক্তি
প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, আবেগ, অনুভূতি ও পারিপার্শ্বিক মানুষজন
দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করে, তখন সেটা জ্ঞানীয় পক্ষপাতে পরিণত
হয়। ধরুন এমনও মানুষ আছে যারা বিবাহ বিষয়টাকে অপছন্দ করে, তারা স্বাভাবিক ভাবেই বিবাহিত
জীবনের মধ্যে নানা রকমের ভুল খুঁজে বার করবে এবং বিবাহ করা কেন খারাপ সেটাই মানুষের
কাছে প্রচার করবে। এখন মানুষ তার যুক্তিকে মেনে নিয়ে যদি বিবাহ করা বন্ধ করে দেয়, তবে
সমাজ ও রাষ্ট্র দুইই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যারা বিবাহ করছে তারা কিন্তু ভুল নয়।
তাই যারা পবিত্র শাস্ত্র বাইবেলের মধ্যে ওই তথাকথিক বৈজ্ঞানিক ভুল খুঁজে পায়, তারা
আসলে বাইবেলকে ঘৃণা করে। কারণ বাইবেল যে মানুষের আসল রূপ প্রকাশ করে দেয়! মানুষের অসৎ
সকল কাজকর্ম, তার নিম্ন স্বভাবের কামনা বাসনা এবং তার অপকর্মের পরিষ্কার বর্ণনা বাইবেলের
প্রতিটি পৃষ্ঠা তুলে ধরে। আর যারা ঐ ধরণের জীবনযাপন করে, তাদের কাছে পবিত্র বাইবেল
এক মূর্তিমান তিরস্কার! বাইবেলের প্রতিটি কথা তাদের বিরুদ্ধে জগতসুদ্ধ লোকের সামনে
সাক্ষী দেয়। এই কারণেই তারা বাইবেলকে ঘৃণার চোখে দেখে, বাইবেলকে মিথ্যা বলে মনে করে।
কিন্তু সে কথা মুখে সরাসরি না বলে, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তির অজুহাত দেখিয়ে বাইবেলকে
মিথ্যা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে। মানুষের জীবনটা কিন্তু শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও যুক্তির
উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে নেই। মানুষ হল এক চেতন প্রাণী। তার মধ্যে বিবেক আছে, আছে আবেগ
ও অনুভূতি। আবার এই সবকিছুর ঊর্ধেও মানুষের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যা কেবলমাত্র যুক্তি
ও বিজ্ঞান দ্বারা জানা, বোঝা, কিংবা ব্যাখ্যা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। অতএব, বাইবেল
পড়তে চাইলে তা পড়ুন, কিন্তু নিজের মতো করে নয়, বরং তারই মতো করে। আর তবুও যদি আপনি
বাইবেলের মধ্যে ভুল খুঁজেও বের করেন, তবে এ কথাও জেনে রাখুন, আপনি যে বিষয়কে সত্য বলে
বিশ্বাস করেন, তার মধ্যেও ভুল খুঁজে বের করে এমন বহু মানুষ বর্তমানে আছে। আর তারাও
তাদের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি পেশ করবে।
প্রভুর বিধান ত্রুটিহীন, প্রাণকে সঞ্জীবিত করে;
প্রভুর নির্দেশবাণী সুনিশ্চিত, সরলমতিকে প্রবুদ্ধ করে।
প্রভুর আজ্ঞাবলি ন্যায়সঙ্গত, হৃদয়ে আনন্দদায়ী;
প্রভুর আদেশবাণী প্রাঞ্জল, নয়নে আলোক সঞ্চারী। (সামসঙ্গীত ১৯:৭-৮)