পৃথিবীর বুকে যতগুলি ধর্ম রয়েছে, তাদের সকলেরই মধ্যে মৌলিক (Fundamental) বিষয়গুলির বৃহৎ পার্থক্য আছে। আপাত দৃষ্টিতে প্রতিটি ধর্ম সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও; মানুষ কেন এই পৃথিবীতে জন্মেছে, কেন তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি, পাপ পুণ্য কি, মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মার কি হয়, স্বর্গ নরক কি; এই সব বিষয় নিয়ে প্রতিটি ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা আছে। আবার সেই সকল ব্যাখ্যা নিয়েও মানুষের মধ্যে তর্ক বিতর্কের অন্ত নেই। ঐ কারণেই প্রতিটি ধর্মকে সমান বলে মনে করাটা এক প্রকারের মুর্খামি। প্রতিটি ধর্ম যে সমান নয়, তার যথাযথ কারণ উল্লেখ করে এর আগে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে; সেটা পড়বার অনুরোধ করছি। আসলে, জাগতিক বিষয় মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে, তা সহজেই আমাদের মনের মধ্যে একটা স্পষ্ট ধারনা তৈরী করে দেয় কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে তেমনটি হয় না। দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত যেমন আছে, তেমনই আছে অদৃশ্য অতিন্দ্রিয় জগত। এই জগতের নিয়মকানুন মানুষের যুক্তি তর্ক ও চেনা পরিচিত মাপকাঠির বাইরে। তাই যারা স্বভাবে যুক্তিবাদী, এবং যারা সমস্ত বিষয়কে বিজ্ঞানের আতশ কাঁচের নিচে ফেলে যাচাই করে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে চেষ্টা করে, তাদের কাছে অদৃশ্য ঐশ্বরিক জগতের সমস্ত রহস্য, সমস্ত অজানা তথ্য, অজানাই থেকে যায়। খ্রীষ্টধর্ম মানুষকে সেই সকল অজানা রহস্য ও তথ্য জানতে সাহায্য করে এবং সেই গভীর জ্ঞান লাভ করার উপায়ও বলে দেয়। তাই পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বর মানুষকে বলেছেন, “একবার ডাক আমায়, সাড়া দেব আমি; তোমাকে শোনাব মহান নিগূঢ় কত কথা, যা তুমি জানই না।” (জেরেমিয়া ৩৩:৩)। আপনি হয়তো আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, “যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞানমনস্ক হলে ক্ষতিটা কি?” আমার উত্তর, “কোনও ক্ষতি নেই! তবে মানুষ তো যান্ত্রিক বস্তু নয়, সে একটা চেতন প্রাণী। যার মধ্যে রয়েছে আবেগ, অনুভুতি আর চেতনা। কম্পিউটার মানুষের চাইতে অনেক বেশি যুক্তিবাদী। সে তথ্য বিশ্লেষণ করতে Boolean Algebra ব্যাবহার করে থাকে। কিন্তু আবেগ, অনুভূতি আর চেতনা কি হয়, সেটা কম্পিউটারের জানা নেই। এখন আপনি যদি সব ব্যাপারেই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ভাব দেখান, তাহলে আপনি আর মানুষ নন, একটা জীবন্ত লাশ! একটা জড়পদার্থ! ভালোবাসা, দয়া মায়া, স্নেহ সম্মানবোধ আর চেতনা; এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে আপনি আপনার যুক্তি আর বিজ্ঞান দিয়ে কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতার মানুষ জানে, কখন কোথায় যুক্তি ব্যাবহার করতে হয়, আর কোথায় তা ব্যাবহার করতে নেই।
পূর্বজন্ম এবং পরোজন্ম ধারনা ও উৎপত্তি
সহজভাবে বলতে গেলে, পূর্বজন্ম, যা বোঝাতে আবার ‘জন্মান্তরবাদ’ শব্দটিও অনেক সময়
ব্যাবহার করা হয়ে থাকে, এটি এমনই একটি
দার্শনিক ধারনা ও ধর্মীয় বিশ্বাস, যা মানুষের মৃত্যুর
পর তার আত্মার অন্য দেহ ধারণ করে নতুন এক জীবন শুরু করাকেই বোঝায়। এই ভাবে একজন মানুষ দৈহিক ভাবে মারা গেলেও, তার আত্মা নতুন এক দেহে জন্ম লাভ করে, নতুন নামে আর নতুন পরিচয় নিয়ে ফিরে আসে। তবে এই বিশ্বাসের উৎস কি? এশিয়া মহাদেশের
মধ্যে যে চারটি জনপ্রিয় ধর্মগুলি রয়েছে, যেমনঃ হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম এবং শিখধর্ম; এই সবকটি ধর্মের
মধ্যেই পূর্বজন্ম এবং পরজন্মের উপর বিশ্বাস বিদ্যমান। এই চারটি ধর্মই স্বীকার করে যে মানুষের আত্মা অমর। আত্মার কোন মৃত্যু নেই। তাদের দাবী, যতদিন মানুষ তার
সঠিক কর্ম দ্বারা পূর্বজন্মের কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করে, ততবার সে বারে বারে পৃথিবীতে দেহধারণ করে জন্ম লাভ করতে থাকবে। অতএব ‘পুনঃজন্মের’ এই কঠিন চক্রব্যূহ
থেকে যে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে, সেই পাবে পরিত্রাণ। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছিল গৌতম বুদ্ধের ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’। জৈনধর্মে আবার, আত্মা তার কর্মের উপর নির্ভর করে মৃত্যুর পরে অস্তিত্বের চারটি অবস্থার যেকোনো একটি অবস্থায় যেতে পারে।
পূর্বজন্ম এবং পরজন্মের ধারণা, সংসার ও মুক্তি আংশিকভাবে তপস্বী ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যা প্রথম হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল, -[Flood,
Gavin. Olivelle, Patrick. 2003. The Blackwell Companion to Hinduism. Malden:
Blackwell. pp. 273–274.] পূর্বজন্ম এবং পরজন্মের ধারণার প্রথম পুঁথিগত উল্লেখ পাওয়া যায় শেষের বৈদিক যুগের উপনিষদে
(আনুমানিক: ১১০০ - ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), বুদ্ধ ও মহাবীরের পূর্ববর্তী সময়ে, -[Damien
Keown(2013), Buddhism: A Very Short Introduction। Oxford University Press]। প্রাথমিক বৌদ্ধ গ্রন্থে সংসারের মতবাদের অংশ হিসেবে পুনঃর্জন্ম নিয়ে আলোচনা
করা হয়েছে। এটি দাবি করে যে অস্তিত্বের প্রকৃতি হল "জীবন, মৃত্যু, পুনর্জন্মের
যন্ত্রণা, ভারাক্রান্ত চক্র, শুরু বা শেষ। এটিকে অস্তিত্বের চাকা (ভবচক্র)
হিসাবেও উল্লেখ করা হয়, এটি প্রায়শই বৌদ্ধ
গ্রন্থে পুনর্ভবা (পুনর্জন্ম, পুনরুত্থান) শব্দের
সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্তিত্বের এই চক্র থেকে মুক্তি, নির্বাণ হল বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, –[ Jeff
Wilson (2010), Saṃsāra and Rebirth, in Buddhism, Oxford University
Press]।
আবার মহাবীর-পরবর্তী প্রাচীন যেসকল জৈনধর্মের
গ্রন্থগুলি যা আজও টিকে আছে , সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম হাজার বছরের শেষ শতাব্দী থেকে, তাতে ব্যাপকভাবে পুনর্জন্ম ও কর্ম মতবাদের উল্লেখ রয়েছে। জৈন দর্শন অনুসারে
আত্মা (জৈনধর্মে জীব; হিন্দু ধর্মে
আত্মা) বিদ্যমান এবং চিরন্তন, স্থানান্তর ও
পুনর্জন্মের চক্রের মধ্য দিয়ে যায়। মৃত্যুর পর, নতুন দেহে পুনর্জন্মকে প্রাথমিক জৈন গ্রন্থে তাৎক্ষণিক বলে দাবি করলেও, সঞ্চিত কর্মের উপর নির্ভর করে জীব, পুনঃজন্মে উচ্চ বা নিম্ন শারীরিক আকারে ধারণ করে, আবার স্বর্গ বা নরক বা পার্থিব রাজ্যে
অবস্থান করতে পারে। তাদের দাবী, কোন শারীরিক গঠন
স্থায়ী হয় না: প্রত্যেকেই মারা যায় এবং আবার পুনর্জন্ম নেয়। পুনর্জন্ম থেকে
মুক্তির (কৈবল্য) উপায় আছে, যাইহোক, একজনের আত্মার কর্ম্ম তা নির্ধারণ করবে, –[ John E. Cort
(2001), Jains in the
World: Religious Values and Ideology in India। Oxford
University Press, Page 118–119]।
শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক ১৫ শতকে ভারতে
জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের চক্রাকার পুনর্জন্মের ধারণা এবং
ইসলামের ধর্মের রৈখিক ধারণার মধ্যে একটি মধ্যবর্তী পথ বেছে নিয়েছিলেন। শিখধর্ম
হিন্দুধর্মের মতোই পুনর্জন্ম তত্ত্ব শেখায়, তবে
এর কিছু পার্থক্য রয়েছে। শিখধর্মের মতে, আত্মা একটি
চিরন্তন সত্ত্বা যা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে। আত্মা মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্রে
আটকা পড়ে এবং মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয়।
প্রতিটি জন্ম কর্ম দিয়ে শুরু হয়। কর্ম হল একজনের চিন্তা, কথা এবং কাজের সমষ্টি। কর্ম একজনের আত্মার উপর কর্মিক স্বাক্ষর (কর্ণী)
রেখে যায় যা ভবিষ্যতের পুনর্জন্মকে প্রভাবিত করে। মৃত্যু ও পুনর্জন্ম চক্র থেকে
মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হল ঈশ্বরের কৃপায় পৌঁছানো। ঈশ্বরের কৃপা একজনকে
কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয় এবং মুক্তি বা মোক্ষ প্রদান করে। শিখধর্মের অনুশাসনগুলি মুক্তির জন্য ভক্তির উপর জোর দেয়। শিখরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের নাম জপ করা মুক্তির
জন্য একমাত্র পথ। শিখরা প্রতিদিন নাম স্মরণ করার মাধ্যমে এবং ঈশ্বরের কাছে নিজেকে
নিবেদিত করার মাধ্যমে মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়, –[Arvind-Pal
Singh Mandair (2013); Sikhism: A Guide for the Perplexed. A&C Black. Page
145–147]।
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে এশিয়া মহাদেশ, তথা ভারতীয় ধর্মগুলির মধ্যে কি ভাবে পূর্বজন্ম ও পরজন্মের ধারণা ও
বিশ্বাসের কিভাবে জন্ম হল, তার একটি প্রাথমিক ধারণা
আমরা পেলাম। আমরা এও জানলাম
যে, উল্লিখিত ধর্মগুলি মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য
থাকলেও, মূল ধারণা সকলেরই এক। তবে এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় যেহেতু পূর্বজন্ম ও
পরজন্মের অস্তিত্ব নিয়ে, সেহেতু, এর বিভিন্ন দিকগুলি আমরা ঐশতাত্ত্বিক ভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করে দেখবো
এবং জানবো কেন পূর্বজন্ম ও পরজন্মের এই বিশ্বাস খ্রীষ্টধর্মে গ্রহণীয় নয়।
পূর্বজন্ম ও পরজন্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণ
খ্রীষ্টধর্মে পূর্বজন্ম বা পরজন্মের (জন্মান্তরবাদ) অস্তিত্বে বিশ্বাস করা
হয়না। সৃষ্টিকর্তা
ঈশ্বর, মানুষকে এই পৃথিবীতে একবারই মাত্র জীবন দিয়ে পাঠান। এই পার্থিব জীবনে মানুষকে নিজের
পছন্দমতো একটা পথ বেছে নেওয়ার ইচ্ছা-ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীনতা দান করে থাকেন। সকল মানুষের সামনে পরত্রানের পথ আর অনন্ত শাস্তির পথ দুইই খোলা আছে। ঈশ্বর মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধীনতায় কখনই হস্তক্ষেপ
করেন না। এখন মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ
করে যে পন্থা অবলম্বন করে জীবনযাপন করবে, তার মৃত্যুর পর সেই মাপকাঠি অনুযায়ী ঈশ্বর তার বিচার করবেন এবং তারপর স্বর্গ
কিংবা নরকে সেই আত্মার স্থান হবে। সেই আত্মা আর কখনও পৃথিবীতে ফিরে
আসবে না। আবার নতুন মানবদেহও ধারণ করবে
না। পুনর্জন্মবাদীদের
অনেক সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত খ্রীষ্টীয় শিক্ষার
অভাবে খ্রীষ্টধর্মের মৌলিক বিশ্বাসগুলি সম্পর্কে তারা সঠিকভাবে অবগত নয়। যার ফলস্বরূপ খ্রীষ্টধর্ম যখন; ঈশ্বর, সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষ, জীবন, মৃত্যু ও পরিত্রানের বিষয়ে যে সত্য প্রকাশ করে, সেটা তাদের কাছে দুর্বোধ্য বলে মনে হয়। আমি প্রায়ই মানুষকে একটা কথা বলি, “কোনকিছুকে
সত্য বলে বিশ্বাস ক'রে গ্রহন করার আগে, সে বিষয় নিয়ে আমাদের গভীর ভাবেই ভেবে দেখা উচিত। যাতে সেটা সত্য বলে মেনে নেওয়ায় পর, তা নিয়ে যেন আর দ্বিতীয়বার ভাবতে না হয়।” মানুষের পুনর্জন্ম যে হয়না, খ্রীষ্টধর্ম
ও পবিত্র বাইবেলে এ বিষয়ে ঠিক বলা হয়েছে, সে নিয়ে
আমরা আরও বিস্তারিত ভাবেই জানবো। কিন্তু তার আগে জেনে নিই, কৃষ্ণ গীতায় পুনর্জন্মের
বিষয়ে যে দুটি কথা বলেছেনঃ
ক) দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা । তথা
দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ।। (গীতা, অধ্যায় ২ /শ্লোক ১৩)
বঙ্গানুবাদঃ ঠিক যেমন শরীরে শৈশব, যৌবন এবং বার্ধক্য একটি মূর্ত জীবের ক্ষেত্রে ঘটে। তাই সে (মূর্ত
সত্তা) অন্য দেহ লাভ করে। জ্ঞানী ব্যক্তি এ সম্পর্কে বিভ্রান্ত হন না।
খ) বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি
গৃহ্নাতি নরোহপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ।। (গীতা, অধ্যায় ২ /শ্লোক ২২)
বঙ্গানুবাদঃ যেমন, জীর্ণ পোশাক ফেলে দেওয়ার পর, একজন মানুষ
পরে নতুন পোশাক নেয়। তাই জীর্ণ দেহগুলিকে সরিয়ে দেওয়ার পরে, মূর্ত আত্মা অন্য নতুনদের মুখোমুখি হয়।
গীতার এই শ্লোক দুটি পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে আত্মার জন্মান্তরের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি এই শ্লোক দুটি নিয়ে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন, তবে আপনার মনে স্বাভাবিক ভাবেই কিছু প্রশ্নের উদয় হবে। যেমনঃ
১) কোনটা
প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে? দেহ না আত্মা?
২) যদি
দেহ প্রথমে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে দেহের শেষ পরিনাম
যে মৃত্যু সেটা কে নির্ধারণ করেছে? মানুষ নিজে না
কৃষ্ণ?
৩) যদি
আত্মা প্রথমে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সেই আত্মা যে
দেহের দ্বারা প্রভাবিত হবে সেটা কে নির্ধারণ করেছে? মানুষ
নিজে না কৃষ্ণ?
৪) যদি
দেহ ও আত্মা একই সাথে একই সময়ে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে
আত্মা চিরজীবী হবে আর দেহ নশ্বর হবে এটা কে নির্ধারণ করেছে? মানুষ নিজে না কৃষ্ণ?
৫) যদি
এই সমস্ত কিছু, কৃষ্ণ নিজেই ঐ ভাবে মানুষকে সৃষ্টি
করে থাকেন, তবে মানুষ ভাল কাজ করলেও একদিন মারা যাবে
আবার খারাপ কাজ করলেও মারা যাবে। এমন অবস্থায় মানুষ কি করতে পারে?
প্রকৃত অর্থে যারা ঐশতত্ত্বের বিশ্লেষণ (Theological
Analysis) সম্বন্ধে অবগত, তাদের
কাছে ঐ প্রশ্নগুলি অবান্তর বা অস্বাভাবিক বলে মনে হবে না। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসকে, তারই মাপকাঠিতে যাচাই করা হয়। যেমন চিকিৎসকের জ্ঞানবিদ্যা দিয়েই তার চিকিৎসক হওয়ার প্রমাণ দিতে হয়। উল্লখিত প্রশ্নগুলি কিন্তু পুনর্জন্ম তত্ত্বের দিকে
কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বলে থাকেন, গীতায়
নাকি মানুষের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে। দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত ঐ সকল প্রশ্নের
উত্তর, গীতা আমাদের দেয়না। আর এখানেই সমস্যা বেঁধেছে। কি সমস্যা? সমস্যা হল, গীতা অনুসারে মানুষের কর্মই যেহেতু কর্মফল উৎপন্ন করে; সেহেতু কর্মফলই নির্ধারণ করে দেবে জীবের মৃত্যুর পর তার আত্মা কোথায়
এবং কি রুপে জন্মগ্রহণ করবে। আসলে, পুনর্জন্ম ও কর্মফল একই
পয়সার দুই পিঠ। এর একটিকে ছাড়া
অন্যটির কোনও অস্তিত্ব নেই। এবার বুঝতে পারছেন কি? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, কৃষ্ণ নিজেই গীতার মধ্যে দুজায়গায় দুরকমের কথা বলেছেন, যেটা জানবার পর আপনি নিজেই দন্ধে পড়ে যাবেন এবং আত্মার জন্মান্তর নিয়েও ভাবতে বাধ্য হবেন।
এক জায়গায় তিনি বলছেনঃ
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন। তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।। (গীতা, অধ্যায় ৪/ শ্লোক ৫)
বঙ্গানুবাদঃ হে অর্জুন, আমার ও তোমার অতীতে বহু জন্ম হয়েছে, সেই সমস্ত জন্মের কথা আমি জানি, কিন্তু তুমি তা জানো না।
আবার অন্য এক
জায়গায় বলেছেনঃ
যো মামজমনাদিং চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্। অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্যেষু সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।। (গীতা, অধ্যায় ১০/ শ্লোক ৩)
বঙ্গানুবাদঃ যিনি আমাকে অজন্মা, অনাদি, সমস্ত লোকের মহেশ্বর বলে জানতে পারেন, মর্তের মানুষ্যমধ্যে সেই পুরুষ জ্ঞানবান।
উপরের শ্লোক
দুটিতে কৃষ্ণ স্ববিরোধী মন্তব্য করছেন। উপরের শ্লোক দুটির মধ্যে আপনি কোনটা বিশ্বাস করবেন? কৃষ্ণের বহুবার জন্ম হয়েছে, নাকি তাঁর কখনই
জন্ম হয়নি, কোনটা সত্য?
কৃষ্ণ অর্জুনকে স্পষ্টই বলেছেন, ‘তাঁর এবং অর্জুনের এই পৃথিবীতে বহুবার জন্ম’ হয়েছে। কৃষ্ণের সেই সব
জন্মের কথা মনে থাকলেও, অর্জুনের সেই সব কথা মনে
নেই। প্রশ্ন ওঠে, কৃষ্ণের এই পৃথিবীতে বহুবার জন্মের মূল কারণ কি? গীতা অনুসারে, মর্ত মানুষেরই বার
বার জন্ম হয় (গীতা, অধ্যায় ২ /শ্লোক ১৩)। যেহেতু তাকে কৃত পাপের কর্মফল ভোগ করতে হয়। তাহলে দেখতে গেলে কৃষ্ণ একজন মানুষ মাত্র, তিনি ঈশ্বর নন! কৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হতেন
তাহলে তিনি বহুজন্মের চক্রে আবদ্ধ হতেন না। এখন হিন্দুধর্মাবলম্বী হয়তো বলবেন, “অধর্মকে
দূর করার জন্য এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভগবান কৃষ্ণ পৃথিবীতে বার বার জন্ম
গ্রহণ করেন”। কিন্তু এতে তো ভগবান
কৃষ্ণের দুর্বলতাই প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ অধর্ম দূর করার স্থায়ী সমাধান তিনি করতে পারছেন না বলেই, এই ধরধামে তাঁকে বার বার জন্ম নিতে হচ্ছে। তার সাথে এটাও প্রমাণ হয় যে, মানুষ এবং ভগবান
কৃষ্ণের মধ্যে এক্ষেত্রে কোনই পার্থক্য নেই, যেহেতু দুজনেরই পৃথিবীতে বহুবার জন্ম হচ্ছে।
পাঠক, একবার
ভাবুন। একজন ব্যাক্তি
তার পূর্বকৃত কিছু কর্মদোষে আবার নতুন দেহে জন্ম নিয়েছে, অথচ তার মনে নেই সে আগের জন্মে ঠিক কি কি অন্যায় কর্ম করেছে। এখন এই জন্মে তাকে সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে
হবে। আপনি কি করে সেই অন্যায়ের
প্রায়শ্চিত্ত করবেন, যে অন্যায়ের কথা
আপনার মনেই নেই? এটা কি একজন
মানুষের প্রতি নৈতিক বিচার করা হল? নারীরা কেন ধর্ষিত
হচ্ছে, তার কারণ হিসেবে এক হিন্দু ব্যাক্তি বলেছিলেনঃ “ঐ মহিলারা আগের জন্মে নিশ্চয়ই কিছু পাপ করেছিল, যার শাস্তি তাদের এই জন্মে পেতে হচ্ছে!” ভাবুন
একবার! শুধু কি নারীরাই ধর্ষিত হয়? ছোট শিশুরা কি ধর্ষিত হয় না? একজন শিশু
ধর্ষিত হল, কারণ সে তার আগের জন্মে কিছু পাপ করেছে। বলতে পারেন, একটা
শিশু পাপ পুণ্যের ব্যাপারে কি বোঝে? আবার অনেক সময়
পুরুষরাও ধর্ষিত হয়। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটনা চাপা পড়ে যায়। সে যাই হোক, পূর্বজন্ম কিংবা
জন্মান্তরবাদ মানুষের প্রতি নৈতিক অবিচার করে। সোজা কথায় বলতে গেলে আপনি পূর্বজন্মের দোহাই দিয়ে যে কোন মানুষকে
পূর্বজন্মের কৃত পাপের জন্য দোষী সাবস্ত করতে পারেন।
এদিকে আবার বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুসারে জানা
যায় যে, গৌতম বুদ্ধ অন্য জগতে
পরকালের অস্তিত্ব এবং পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেছেনঃ
“যেহেতু প্রকৃতপক্ষে অন্য জগৎ
আছে (বর্তমান মানুষের পৃথিবী ব্যতীত অন্য যেকোন জগত, অর্থাৎ বিভিন্ন পুনর্জন্মের ক্ষেত্র), যার
দৃষ্টিভঙ্গি 'অন্য কোনো জগত নেই' তার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি আছে...”
— বুদ্ধ, মজ্ঝিমনিকায় ১.৪০২, আপন্নাকা সুত্তা [Peter
Harvey (2012), An Introduction to Buddhism: Teachings, History and
Practices. Cambridge University Press]
তিনি আরও বলেছেন যে, মানুষের যে কোনও কর্মফল পুনর্জন্মকে প্রভাবিত করে এবং বারবার জন্ম ও
মৃত্যুর চক্র অন্তহীন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, গৌতম বুদ্ধের জন্মের বহু
আগে, প্রাচীন ভারতীয় কিছু পণ্ডিতেরা পরকালের
প্রতিযোগীতামূলক অনেক তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন, যার
মধ্যে একটি হল চার্বাকের মতো বস্তুবাদী তত্ত্ব। এই বিশ্বাস অনুসারে মৃত্যুতেই সব শেষ, কোন
পরকাল নেই, কোন আত্মা নেই, কোন পুনর্জন্ম নেই, কোন কর্ম নেই, কোন কর্মফল নেই এবং তারা মৃত্যুকে এমন অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন যেখানে
জীবআত্মা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস, বিলীন হয়ে যায়,
[Ray Billington (2002), Understanding Eastern Philosophy]। সাধারণভাবে গুরু বৃহস্পতিকে এই তত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে মনে করা হয়। এই
তত্ত্ব কোনো প্রকার অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী নয়, ‘প্রমাণ’ই এই তত্ত্ব
অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই
মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করে। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে
জানা যায়। চার্বাক তত্ত্ব অনুযায়ী
ইন্দ্রিয়জ সুখই মানুষের জীবনে পরম কাম্য হওয়া উচিৎ কারণ পার্থিব দুঃখই নরক। দেহের উচ্ছেদই হচ্ছে মুক্তি। কারণ মৃত্যুতেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটে। আত্মা বলে কিছু নেই; তাই পরকাল বা পুনর্জন্ম বলেও কিছু নেই। চার্বাকবেত্তারা মানুষের দৃষ্টি অসীম থেকে সসীমের দিকে, আধ্যাত্মিকতা থেকে বাস্তবের দিকে আকৃষ্ট করতে প্রয়াসী। তাদের পরামর্শ মানুষ যেন জীবনের চরিতার্থতার জন্য ভোগে লিপ্ত থাকে। তবে আমার মতে এই তত্ত্বটি বিপজ্জনক। কারণ এই তত্ত্ব মানুষকে নৈতিক ভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন
করে তলে এবং বস্তুকেন্দ্রিক ও শারীরিক আনন্দ উপভোগ করতে মানুষকে উৎসাহিত করে।
এ পর্যন্ত আপনি যদি পড়ে থাকেন, তাহলে আপনার বোধহয় বুঝতে আর বাকি নেই যে; পূর্বজন্ম, পরজন্ম কিংবা
জন্মান্তরবাদ নিয়ে বিভিন্ন ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে। কেউই নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারছে না। আসলে পুরো বিষয়টাই সকলের ব্যাক্তিগত ধারণা এবং কাল্পনিক রচনা। উল্লিখিত যে সকল তথ্যগুলি আমি তুলে ধরেছি, তা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে ধর্মীয় এবং সামাজিক
ভাবনাকে তুলে ধরে। এর কোনটাই আমার ব্যাক্তিগত
মতামত নয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা জানবো, কেন পূর্বজন্ম ও পরজন্ম (জন্মাতরবাদ) বলে আসলে কিছুই নেই। এর বিপক্ষে থাকা প্রমাণগুলি
আমরা জানবো।
জন্মাতরবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিগত সমস্যা ও বাস্তবিক প্রমাণের অভাব
জন্মান্তরবাদ, যা পুনর্জন্ম নামেও পরিচিত, এটি আসলে ধর্মীয় বা দার্শনিক বিশ্বাস যা একটি জীবের মৃত্যুর নতুন একটি শরীরে জীবন
লাভ করাকেই বোঝায়। পুনর্জন্মের ধারণাটি প্রায়
শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিতে এটি পাওয়া যায়, তবে এটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন
ধর্মের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আছে। যদিও পুনর্জন্মের উপর প্রচুর ধর্মীয় এবং দার্শনিক সাহিত্য রয়েছে, তবুও এর অস্তিত্বকে সমর্থন করার জন্য কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই এবং
যুক্তিসঙ্গত ভাবেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ক্রমবর্ধমান কিছু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং যুক্তিগত কিছু বিশ্লেষণ রয়েছে যা
পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ ধারণার বিরোধিতা ক’রে তা মিথ্যা
প্রমাণ করে। নিচে আমরা সেই সকল বিরোধিতা
সম্বন্ধে জানবো।
প্রথম সমস্যাঃ মানুষের জনসংখ্যার ক্রমশ বৃদ্ধি
এটি হল জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্মের বিরুদ্ধে
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ। যদি মানুষের পুনর্জন্ম সত্য হয়, তবে
পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা একই থাকবে। অর্থাৎ, যদি পৃথিবীতে মানুষের
জনসংখ্যা ১০০০০০ হলে, তবে সেটা সবসময়ই ১০০০০০-ই থাকবে। না বাড়বে, না কমবে। যেহেতু আত্মা পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ
করে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিনিয়ত মানুষের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ourworldindata.org এর তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে সাড়া পৃথিবীতে মানুষের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ কোটি। এখন বর্তমানে তা প্রায় ৮০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ বা United Nations এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আগামি ২০৫০ সালের মধ্যে মানুষের মোট জনসংখ্যা গিয়ে
দাঁড়াবে প্রায় ১০০০ কোটির কাছাকাছি।
দ্বিতীয় সমস্যাঃ নতুন আত্মার সৃষ্টি
যদি পুনর্জন্ম সত্যি হয়, তবে জগতের বুকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক আত্মারই অস্তিত্ব থাকবে। যেহেতু আত্মা শাশ্বত, যেহেতু তার কোনও মৃত্যু নেই, অতএব তার
কোনও পরিবর্তন ঘটাও সম্ভব নয়। যখন প্রথম পুরুষ এবং নারী সৃষ্টি হয়েছিল, তখন তারা আত্মাসহ সৃষ্টি হয়েছিল। এখানে সে ক্ষেত্রে দুটি আত্মাই বিদ্যমান। কিন্তু তাদের যখন সন্তান হল, যে নিজেও একটি
মানুষ; সে তার আত্মা পেল কোথা থেকে? কারণ তার পিতা ও মাতা তখনও বেঁচে! একজনের
মৃত্যু হলেই, তবেই তো নতুন এক মানুষের জন্ম হয়। কিন্তু এখানে তেমনটি কিন্তু ঘটলো না। বরং অতিরিক্ত একটা আত্মা সৃষ্টি হল।
তৃতীয় সমস্যাঃ পূর্বজন্মের স্মৃতির অভাব
যদি পুনর্জন্ম সত্যি হয়, তবে প্রতিটি মানুষের পূর্বজন্মের কথা মনে থাকা উচিত। যেহেতু আত্মা শরীর পাল্টেছে, নিজের অস্তিত্ব পাল্টায়নি। তবে সমস্ত মানুষের, তার পূর্বজন্মের কথা মনে
নেই কেন? আত্মা নতুন শরীরে স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে, তার পূর্বজন্মের স্মৃতিও নতুন শরীরে স্থানান্তরিত হওয়া উচিত।
চতুর্থ সমস্যাঃ মন্দতার সমস্যা
যদি পুনর্জন্ম সত্যি হয়, তবে যারা ভালো মানুষ তাদের সাথে খারাপ কেন হয়? আর যারা খারাপ মানুষ তাদের সাথে ভালো কেন হয়? এ কথা মনে রাখতে হবে, মানুষের পুনর্জন্ম
তার জীবনের কর্মফলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে সংযুক্ত।
পঞ্চম সমস্যাঃ নৈতিক অবক্ষয়
পুনর্জন্মের ধারণা মানুষের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় তৈরী করে। এই বিশ্বাস যে, কোনও
মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে এবং তার জীবনে অনেক জ্বালা যন্ত্রণা আছে; কারণ সে পূর্বজন্মে কিছু দুষ্কর্ম করেছিল। এর ফলে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি ও দয়ার অভাব দেখা দিতে পারে। যদিও সে পূর্বজন্মে ঠিক কি কি দুষ্কর্ম করেছে, তা আমদের কারও জানা নেই। উদাহরণঃ এক নারী
ধর্ষিত হল, সে পূর্বজন্মে কিছু দোষ করেছে।
ষষ্ঠ সমস্যাঃ সমান বৈশিষ্টের অভাব
যদি পুনর্জন্ম সত্যি হয়, তবে আগের জন্মে ঐ মানুষটি ঠিক যেমনটি ছিল, তার এই নতুন জন্মেও সে একই রকমের হবে। অর্থাৎ, একটা মানুষের
চারিত্রিক বৈশিষ্ট, তার প্রতিভা, তার গুণ ও তার স্বভাব, তার পরের জন্মে
নতুন দেহে স্থানান্তরিত হবে। যদি জন্মান্তরবাদ সত্যি হয়, তাহলে
প্রাচীন কালের বহু মানুষকে আমরা আবার দেখতে পেতাম। কিন্তু আমরা বাস্তবে এমনটি দেখতে পাইনা। উদাহরণঃ যদি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুনর্জন্ম হয়, তাহলে তিনি তাঁর নতুন এই জন্মেও একই থাকবেন।
সপ্তম সমস্যাঃ অন্যায্য ব্যাবস্থা
একজন ব্যাক্তির পুনর্জন্ম হয়েছে। এই জীবনে সে বিভিন্ন যন্ত্রণা পাচ্ছে তার
পূর্বজন্মের দোষের কারণে। এটা কি ন্যায্য
বিচার হল? একজন মানুষ তার
পূর্বজন্মের কৃতকর্মের শাস্তি এই জন্মে কেন ভোগ করবে? যখন তার মনেই নেই, সে তার আগের জন্মে কি
অন্যায় করেছে। একটা মানুষকে কি
শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, যখন সে জানেই না, সে কি অপরাধ করেছে।
অষ্টম সমস্যাঃ সম্যতা বলে কিছু নেই
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, পূর্বজন্মের পাপের ফলে পরবর্তী জন্মে মানুষ নিম্নজাতিতে জন্মগ্রহণ করে। যারা সমান অধিকার (Equal Rights) বা সম্যতায় (Equality) বিশ্বাস রাখেন, এক্ষেত্রে তারা কি
বলবেন? কারণ পুনর্জন্মের তত্ত্ব, সমান অধিকার কিংবা সম্যতাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং পরস্পরবিরোধী।
নবম সমস্যাঃ সত্ত্বার অবনতি
পুনর্জন্মের ক্ষেত্রে এমনটাও বিশ্বাস করা হয় যে, একটি মানুষ তার কর্মদোষে পরবর্তী জন্মে পশুপাখি কিংবা কীট-পতঙ্গ রুপে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু এখানে সব থেকে বড় সমস্যা হল, পশুপাখি কিংবা কীট-পতঙ্গের স্বাধীন ইচ্ছা (Free
Will) শক্তি নেই যেমনটা মানুষের আছে। তাছারা তাদের মধ্যে চেতনা ও বিবেক বলেও কিছু নেই। অতএব, তারা যা করে, সহজাত স্বভাবের তাড়নাতেই করে। এদিকে আত্মার মধ্যে চেতনা আছে। সে স্বয়ংক্রিয়। যদি একটি মানবাত্মা পরের জন্মে
মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হয়ে জন্মায়, তবে সে নিজের সিধান্তে কিছুই করতে পারবে না। প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তাকে সবকিছু করতে হবে। তার নিজের কোন কর্মফল নেই। তার নিজের যদি কোনও কর্মফল না থাকে, তাহলে আত্মা কোনও কর্মফল পেল না। যেহেতু আত্মার পুনর্জন্ম মানুষের কর্মফলের উপর নির্ভরশীল, সেহেতু আত্মা সঠিক কর্মফলের অভাবে পরের জন্মে উন্নতি করতে পারবে না।
উপরে উল্লেখ করা
এই সমস্ত কারণগুলি জন্মান্তরবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে। এছারা আরও অনেক কারণ আছে, যা এখানে আমি
উল্লেখ করলাম না। তাহলে লেখাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে
যাবে। ও আচ্ছা, এখানে আর একটি বিষয় আছে। অনেকে জন্মান্তরবাদের প্রমাণ হিসেবে, ‘জাতিস্মর’দের উদাহরণ তুলে ধরবেন। ‘জাতিস্মর’ কি? এরা কারা? মনে করা হয় এরা হল
সেই ব্যাক্তি, যাদের পূর্বজন্মের
কথা মনে রাখার অলৌকিক শক্তি আছে। পৃথিবীর বহু স্থানে ছোট শিশুরা নিজেদের জাতিস্মর হিসাবে মনে করে। এদের বয়স সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছর হয়। কিন্তু এদের নিয়ে মনবিজ্ঞানের মহলে অনেক বিতর্ক আছে। যেমনঃ জাতিস্মর সেই সব সমাজেই বেশী আবিষ্কার হয়, যেখানে পূর্বজন্ম এবং পুনর্জন্মের তত্ত্বের উপর প্রবল বিশ্বাস আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতিস্মরের পূর্বজীবন সেই সমাজ অথবা
পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদি পিতৃশাসিত সমাজ হয়, তাহলে জাতিস্মরের পূর্বজীবন পিতার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যদি মাতৃশাসিত সমাজ হয় তাহলে এর উল্টো হয়। আবার এদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে, পূর্বজন্মের স্মৃতিও মিলিয়ে যায়। তবে জাতিস্মরদের পূর্বজন্মের কথা কি ভাবে মনে পড়ে যায়, এটা Cryptomnesia দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। Cryptomnesia হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যখন কোন ব্যাক্তি
এমনকিছু কথা বলে, বা এমন কিছু ক’রে বসে; যার সমন্ধে তার
ব্যাক্তিগত জীবনে কোন সম্পর্কই নেই; তার কাছে এই পুরো ব্যাপারটাই নতুন। অথচ ঐ একই কথা, একই কাজ পৃথিবীর
অন্য কোথাও অন্য কোন মানুষ বহুকাল আগেই সেটা করেছে। এর একটা বাস্তব ঘটনা তুলে ধরছি। জর্জ হারিসন নামের এক ব্যাক্তি ১৯৬৯ সালে “My Sweet
Lord,” নামে একটি গান লিখেছিলেন। পরে এই গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে যায়। কিছু সময় পরে, ব্রাইট টিউনস, জরজের নামে তার গানের সুর চুরি করার অভিযোগে আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। তার অভিযোগ, জর্জ তার গান “He’s So Fine,” এর সুর চুরি
করে নিজের নামে চালিয়েছে। আদলতের বিচারপতি এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে, জর্জ জানান; “আমি গানের সুর চুরি করিনি”। অনেক বিচার বিবেচনার পর, বিচারপতি এই ঘটনাকে “অবচেতন মনের, অনিচ্ছাকৃত কর্ম বলে আখ্যা দেন”। অবশ্য জর্জ হারিসনকে এর জন্য পরে ৮ কোটি টাকা ব্রাইট টিউনসকে পেনাল্টি দিতে
হয়েছিল [https://www.thecut.com/2015/05/science-of-joke-stealing-and-plagiarism.html]। অতএব, জাতিস্মররা যে পুনর্জন্মের প্রমাণ, এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই।
বাংলা সাহিত্যেও পুনর্জন্মের বিরুদ্ধে কিছু রচনা
রয়েছে। তেমন কয়েকটি
উদাহরণের মধ্যে আছে:
· * বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চিত্রাঙ্গদা' নাটকটি। যেখানে পুনর্জন্মের ধারণাটিকে প্রশ্ন করা হয়েছে। নাটকের শেষে চিত্রাঙ্গদা বলেন, "পুনর্জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, একমাত্র জীবন আছে।"
· * শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাসে পুনর্জন্মের ধারণাটিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উপন্যাসের চরিত্র প্রফেসর মজুমদার বলেন, "পুনর্জন্মের কোনো প্রমাণ নেই। এটি কেবল একটি কল্পনা।"
· * উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পগুলিতে প্রায়শই পুনর্জন্মের
ধারণাটিকে খণ্ডন করা হয়। তার গল্প
"পুনর্জন্ম"তে, একজন লোক তার
পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পায় এবং তার পূর্বজন্মের জীবনের খারাপ কর্মের জন্য
শাস্তি পায়। তবে গল্পের শেষে, লোকটি উপলব্ধি করে যে তার পূর্বজন্মের স্মৃতিগুলি আসলে তার অবচেতন মনের ফল।
পবিত্র বাইবেল মানুষের এক ও অদ্বিতীয় জন্মের কথা বলে
এ পর্যন্ত পড়ে আমরা জানলাম যে, জন্মান্তরবাদ তত্ত্বটি একটি অবাস্তব এবং অযৌক্তিক এক বিশ্বাস। যার অনেক দাবী থাকলেও, বাস্তবের পক্ষে এর কোন প্রমাণ নেই, না এটা প্রমাণ করা সম্ভব। যাইহোক, খ্রীষ্টধর্ম বরাবরই মানবজাতিকে এক ও অদ্বিতীয় জন্মের কথা বলে এসেছে। এবং এটা বাস্তব। আজও পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে অবাস্তব বা অযৌক্তিক বিশ্বাসের তকমা কেউই লাগায়নি। উপড়ে উল্লেখিত জন্মাতরবাদের বিপক্ষে যে নয়টি সমস্যা
তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলি এর সপক্ষে
রায় দেয়। জন্মান্তরবাদিরা আপত্তি জানালেও, মানুষের এক ও অদ্বিতীয় জন্মের বিরুদ্ধে প্রমাণ দেওয়ার মতো তাদের কাছে কিছু নেই। ধর্মীয় বিষয় হলেও তা যদি বাস্তবসম্মত হয়, মানুষের তাতে কোন আপত্তি থাকে না। পবিত্র বাইবেল মানুষের এক ও অদ্বিতীয় জীবনের বিষয় ঠিক কি বলছে সেটা এবার জেনে
নিই।
পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বরের এই বাণী দুটি দেখুনঃ “কেন না জীবিত একদিন
সকলেই মারা যাবে। সূর্যের নীচে এখানে যা কিছু হয়, তাতে সে কোনোদিনও অংশ নেবার সুযোগ পাবে না” (উপদেশক ৯:৫-৬); “একথা ভুলো না; কারও আর ফিরে আসা নেই” ( বেনসিরা
৩৮:২১)।
ঈশ্বর এখানে সরাসরি বলছেন, মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর সে আর কখনও পৃথিবীতে ফিরে আসবে না।অর্থাৎ, মানুষের পুনর্জন্ম নেই। মানুষের এক ও অদ্বিতীয় জীবনের বিষয়ে এত স্পষ্ট করে পবিত্র বাইবেলে আর কোথাও
উল্লেখ করা নেই। অবশ্য যেগুলি উল্লেখ করা আছে, সেই সবই হল মানুষের এক ও অদ্বিতীয় জীবনের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা। খ্রীষ্টধর্মে মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর বিষয়ে ঠিক বলা
আছে, সেটা এখানে সংক্ষেপে বলছি।
সৃষ্টির আদি থেকেই ঈশ্বর আছেন। তিনি সময় ও কালের অতীত। তিনি সময় ও জগতের বন্ধনে আবদ্ধ নন। তাঁর আপন সত্ত্বা মানুষের কাছে আজও রহস্যময়। তবে তিনি হলেন ভালোবাসা। ভালবাসাই তাঁর ঐশ সত্ত্বার মৌলিক বিষয়। ভালবাসার প্রেরণায় তিনি মানুষকে সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন তাঁর আপন শাশ্বত সত্ত্বারই প্রতিমূর্তিতে। ঈশ্বর নিজে যেমন স্বাধীন এক সত্ত্বা, মানুষকেও ঠিক তেমনই সৃষ্টি করলেন। অর্থাৎ, মানুষের হাতে থাকবে
নিজের ইচ্ছা মতো চলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রতিটি মানুষকে ঈশ্বর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা নিয়েই সৃষ্টি করে
পৃথিবীর বুকে পাঠান এবং সে কতদিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে
থাকবে, সেই অনুযায়ী
নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া থাকে। যে নির্দিষ্ট সময় মানুষকে বেঁধে দেওয়া আছে, সেই সময়ের মধ্যেই তাকে যে উদ্দেশ্যে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, তা সেটা পূর্ণ করতে হবে। যখন পৃথিবীর বুকে তার সময় পূর্ণ হবে, তখন তার আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঈশ্বরের সামনে বিচারে দাঁড়াতে হবে। সে সাড়া জীবন বেঁচে থাকতে ভালো মন্দ যা কিছু করেছে, তার পঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব ঈশ্বরকে দিতে হবে। যেহেতু, ঈশ্বর তাকে নিজের
ইচ্ছে মতো স্বাধীন ভাবে সবকিছু করবার ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষ নিজের সেই ইচ্ছা স্বাধীনতা প্রয়োগ করে যা কিছু বেছে নিয়েছে, সেই অনুসারে তারই যোগ্য প্রতিফল ঈশ্বর মানুষ দেবেন এবং সব শেষে বিচার শোনাবেন। সেই আত্মা, হয় অনন্তকালের জন্য
স্বর্গে ঈশ্বরের সঙ্গে থাকবে; নয়তো, ঈশ্বরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে অনন্তকাল নরকে থাকবে। যেহেতু আত্মা শাশ্বত, তার বিনাশ নেই। আর বিনাশ নেই বলেই তাকে এমন একটি স্থানে থাকবে হবে যা
শাশ্বত। স্বর্গ এবং নরক দুইই শাশ্বত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি মানুষ মারা যাওয়ার পর সে স্বর্গে যাবে না নরকে তা আমরা কি ভাবে জানবো? উত্তর হল, সেটা নিয়ে আমাদের
ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এটা ঈশ্বর মানুষের কাছ
থেকে লুকিয়ে রেখছেন। পবিত্র বাইবেল বলছেঃ “মানুষ তো জানেই না, ভবিষ্যতে কি হবে; মানুষের মৃত্যুর পর কি হবে না হবে, তা কেই বা জানতে পারে? অথচ যে নির্বোধ, সে কিন্তু কথার জাল বুনেই চলে!” (উপদেশক ১০:১৪)। খ্রীষ্টান হিসেবে আমরা প্রার্থনা করবো, যেন সকল, মানুষই পরিত্রাণ
পায়। কিন্তু শেষ বিচার ঈশ্বরের হাতে। মানুষের মৃত্যুর পর তার বিচার করা হয় এবং বিচারের পর
সেই আত্মার সাথে ঠিক কি হয়, তেমনই একটা ঘটনার
বিবরণ পবিত্র বাইবেলে দেওয়া আছে।
“এক ধনী লোক ছিল, সে দামী রঙিন ক্ষোমের পোশাক পরত, ও প্রতিদিন জাঁকজমকের মধ্যে ভোজসভার আয়োজন করত। তার বাড়ির ফটকের পাশে লাজার নামে এক ভিখারী পড়ে থাকত; তার শরীর ঘায়ে ভরা ছিল,এবং সেই ধনীর টেবিল থেকে
খাবারের যে টুকরোগুলো পড়ত, তা খেতে আকাঙ্ক্ষা
করত; কুকুরেরা পর্যন্তও এসে তার ঘা চেটে খেত। একসময় সেই ভিখারী মারা গেল, আর স্বর্গদূতেরা তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে আব্রাহামের কোলে রাখলেন। সেই ধনীও মরল, এবং তাকে কবর দেওয়া হল। নরকে ভীষণ যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে সে চোখ তুলে বহুদূর থেকে আব্রাহামকে ও
তাঁর কোলে লাজারকে দেখতে পেল। তাই জোর গলায় বলে উঠল, পিতা আব্রাহাম, আমার প্রতি দয়া
করুন, লাজারকে পাঠিয়ে দিন, যেন সে আঙুলের ডগাটুকু জলে ডুবিয়ে আমার জিহ্বা জুড়িয়ে দেয়, কারণ এই আগুনের শিখায় আমি ভীষণ যন্ত্রণা পাচ্ছি। আব্রাহাম বললেন, বৎস, মনে রাখ: তোমার মঙ্গল তুমি জীবনকালেই পেয়েছ, আর লাজার তেমনি অমঙ্গল পেয়েছে; এখন সে এখানে সান্ত্বনা পাচ্ছে, আর তুমি ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগছ। তাছাড়া, আমাদের ও তোমাদের
মধ্যে বিশাল গহ্বরের ব্যবধান রাখা আছে, তাই যারা এখান থেকে তোমাদের কাছে যেতে চায়, তারা পারে না; আবার ওখান থেকে
আমাদের কাছে কেউই পার হয়ে আসতে পারে না।” (লুক ১৬:১৯-২৬)
আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন মৃত্যুর পর মানুষের ঠিক
কেমন ভাবে বিচার করা হয় এবং তার আত্মার যে পুনর্জন্ম হয়না সেটাও এবার জানতে পারলেন। পবিত্র বাইবেলে আবার স্পষ্ট ভাবে এটাও বলা হয়েছে, কোন কোন শ্রেণীর মানুষ স্বর্গে যাবে না, তাদের মধ্যে রয়েছেঃ যৌন অনাচার, অশুচিতা, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা, পৌত্তলিকতা, তন্ত্রমন্ত্র সাধন, শত্রুতা, বিবাদ, ঈর্ষা, ক্রোধ, রেষারেষি, মনোমালিন্য, দলাদলি, হিংসা, মাতলামি, পানোন্মত্ত
হইচইপূর্ণ ভোজ‑উৎসব আর ওই ধরনের সমস্ত কিছু” (গালাতীয় ৫:১৯-২১)। এই শ্রেণীর মানুষ পরিত্রাণ পাবে না। এরা অনন্তকাল নরকে শাস্তি পাবে।
সমাপ্তি
পূর্বজন্ম বা পরজন্ম (জন্মানতরবাদ) নিয়ে অনেক দীর্ঘ
আলোচনা করা হল। একজন পাঠক হিসেবে আপনি যে আপনার অতি মূল্যবান সময় ব্যায় করে এ পর্যন্ত মনোযোগ
সহকারে পড়েছেন, তার জন্য আপনাকে
আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসলে জন্মান্তরবাদ নিয়ে যে পরিমাণ পড়াশুনা আমি করেছি এবং এর বিপক্ষে যে পরিমাণ
তথ্য আমার কাছে আছে; তার মাত্র দশ শতাংশ
এখানে লিখেছি। ঐ সবকিছু খুঁটিয়ে লিখতে গেলে এটা
আর ব্লগ থাকবে না; তখন পাঠক পড়বার
ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু যতটুকু লিখেছি, ততটুকুই জন্মান্তরবাদের অবাস্তবতা বোঝার জন্য যথেষ্ট। আমি আশা করবো, এই লেখাটি পড়ে পাঠক
তার জীবনকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে এবং নিজের জীবনের প্রতিটি ভালো মন্দ
ঘটনাকে দায়িত্ব সহকারে গ্রহণ করবে। তার সাথে সাথে ঈশ্বরের সৃষ্টি একজন মানুষ হিসেবে নিজের প্রতি ও তার আপনজনদের
প্রতি অর্পিত কর্তব্য পালন ক'রে এই সুন্দর মানবজীবন সার্থক করে
তুলবে। প্রভু যীশু খ্রীষ্টের অনুগ্রহ
সকলের উপরে বর্ষিত হোক।