গবেষণায় প্রমাণিতঃ রোজারী জপমালার প্রার্থনা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং জীবনের সমস্যা মোকাবেলায় সাহায্য করে!
গবেষণা ও রোজারী জপমালার প্রার্থনা
আজকাল কমবেশি প্রায় অনেক মানুষই কোন না কোন ভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
মানসিক চাপ থেকে শুরু করে, বিষাদ এবং মানসিক অবসাদের মতো বিষয়গুলি এখন সাধারণ ব্যাপার
হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তারা মানসিক স্বাস্থ্যবিদদের
(Psychologist & Counselor) কাছে গিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে থাকেন। কিছু মানুষ
যোগব্যায়াম বা ধ্যানের মাধ্যমের নিজেদের মানসিক ভাবে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন। আমেরিকা
এবং অন্যান্য পশ্চিমের দেশগুলিতে “Meditation and Mental Health Wellness”
নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলি কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা করছে। তাছারা রয়েছে এমন কিছু
মোবাইল অ্যাপ, কি ভাবে নিজেকে মানসিক ভাবে ভাল রাখা যায়, এর ব্যাবহারকারীদের সেই সংক্রান্ত
নানা ধরণের উপদেশ বা টিপস দিয়ে থাকে। তবে এই সবকিছু করেও মানুষের উপকার হয়েছে যথসামান্যই।
আসলে অধিকাংশ মানসিক সমস্যাগুলি, মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের সমস্যার প্রতিফল।
মানুষের মন একটি আধ্যাত্মিক জিনিস যা নৈতিক স্তরে অবস্থান করে, কিন্তু শারীরিক স্তরে
এর কোন অস্তিত নেই। তাই মানুষের মন দেহের ঠিক কোন জায়গায় অবস্থিত, সেটা আজও বিজ্ঞান
বলতে পারেনি। অথচ, মানুষের এই মন এতটাই প্রভাবশালী যে, এটা তার সমস্ত দেহকে নির্দেশনা
দেয় ও পরিচালনা করে। মানুষের মন খারাপ থাকলে তার কোনকিছুই ভাল লাগে না। তাহলে এই মন
সুস্থ রাখা যায় কী ভাবে? একটি নতুন যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রোজারী
জপমালার প্রাচীন ক্যাথলিক প্রার্থনা অনুশীলন, যোগব্যায়াম ও অন্যান্য ধ্যান কৌশলের
তুলনায় অনেক বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করতে পারে।
The Journal of Religion and Health - এ প্রকাশিত এই
গবেষণাটি রোজারী জপমালার মতো ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় ক্যাথলিক প্রার্থনা সম্পর্কে তৈরি
ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং যারা রোজারী জপমালার প্রার্থনা করে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি
মাসে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আশ্চর্যজনক অন্তর্দৃষ্টি ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু
বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করে এই গবেষণা।
ইতালি, পোল্যান্ড এবং স্পেনের মানসিক স্বাস্থ্যের গবেষকরা ৩৬১ জন গবেষণায়
অংশগ্রহণকারী ক্যাথলিকের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে রোজারী জপমালার প্রার্থনা
মানসিক সুস্থতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ঠিক কতটা প্রভাব ফেলছে। তারা সেটা গভীর
ভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তারা দেখেছেন যে, রোজারী জপমালার প্রার্থনা করা ব্যাক্তিদের
মানসিক সুস্থতার মাত্রা বেশি, যারা এই প্রার্থনা প্রতিদিন করেছে তাদের মধ্যে সহানুভূতি
বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের জীবনে ধর্মীয় সংগ্রাম বা আধ্যাত্মিক উদ্বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে
কম হয়েছে। গবেষকরা আরও দেখেছেন যে ৬২.২% অংশগ্রহণকারী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী
ছিলেন, যা এই গবেষণাকে বৈজ্ঞানিক স্তরে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। কারণ গবেষকদের একাংশ মনে
করেন যে, রোজারী জপমালার মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও পরম্পরাগত ক্যাথলিক ভক্তি মূলত কম
শিক্ষিত মানুষজন মেনে চলে বা পালন করে।
রোমের পন্টিফিকাল ইউনিভার্সিটি অ্যান্টোনিয়ানামের প্রধান গবেষক, ফাদার
লুইস ওভিয়েডো বলেছেনঃ “রোজারী জপমালার ঐতিহ্যবাহী প্রার্থনা অনুশীলন কীভাবে শিক্ষাগত
যোগ্যতা এবং সকল প্রজন্মের সীমানা অতিক্রম করে বহুকাল কাল ধরে মানুষের মধ্যে সক্রিয়
রয়েছে তা দেখে আমরা অবাক হয়েছি,”। ওভিয়েডো সিএনএকে বলেন যে, এই গবেষণার সূচনা হয়েছিল
এই হতাশা থেকে যে, আমাদের চেনা পরিচিত যে সকল মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রিক ব্যায়াম এবং
অন্যান্য ধ্যান কৌশল অনুশীলনের যে সকল পন্থাগুলি মানবসমাজে রয়েছে তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা
করা হয়েছে, কিন্তু রোজারী জপমালার প্রার্থনা সম্পর্কে কার্যত কোন গবেষণাই প্রকাশিত
হয়নি, যদিও এটি স্পষ্টতই ধ্যানের একটি রূপ। তিনি বলেনঃ “আমাদের দল অনুসন্ধান করার
চেষ্টা করেছিল যে আমরা এই রোজারী জপমালার ধ্যান প্রার্থনার সাথে অন্যান্য ধ্যান প্রার্থনা
বা ধর্মীয় অনুশীলনের রূপগুলির সাথে একই রকম মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উপকার খুঁজে
পেতে পারি কিনা,”। “আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা ইতিবাচক ফলাফল পাব কারণ আমার ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা এবং অন্যদের সাক্ষ্য থেকে জানতাম যে এই রোজারী জপমালার প্রার্থনার অর্থ কী
এবং এই প্রার্থনা করবার সময় মানুষজন কেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করে,”।
বাঁধাধরা ধারণার বাইরে
এই গবেষণায় অধ্যয়ন করা তিনটি দেশের খ্রীষ্টীয় সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
প্রকাশ পেয়েছে। ধর্মীয় ব্যাপারে পোল্যান্ডে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছে, অংশগ্রহণকারীদের
রোজারী জপমালা করবার মাত্রা ৩.৭০ স্কোর করেছে (তুলনায়, ইতালি ৩.৩৮ এবং স্পেন ৩.৩৫)।
ইউরোপের খ্রীষ্টান দেশগুলির মধ্যে, সবচেয়ে ধর্মীয়ভাবে সক্রিয় এবং ধর্ম পালনকারী দেশগুলির
মধ্যে পোল্যান্ডের খ্যাতি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশি এবং তাদের জীবনযাপনের
সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণও বটে। যেখানে কয়েক দশক ধরে সাম্যবাদ (Communist) শাসনের আধিপত্য
ও প্রভুত্ব থাকা সত্ত্বেও পোল্যান্ডের ক্যাথলিক ধর্মের খ্রীষ্টান ঐতিহ্যগুলি সামাজিক
কাঠামোর সাথে আজও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
ইতালীর ক্যাথলিক অংশগ্রহণকারীরা রোজারী জপমালার আধ্যাত্মিক অনুশীলনের
ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহানুভূতির স্কোর (৪.৩১) করেছেন। তারা মনে করেন যে এই আধ্যাত্মিক
অনুশীলনের সুবিধাগুলি ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার বাইরেও উন্নত সামাজিক ও মানবীয় সংযোগ
স্থাপন করা পর্যন্ত বিস্তৃত, কিন্তু কেবল ক্যাথলিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ধর্মীয়
চেতনা ইতালির সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির সাথে অনুরণিত। তবে ভ্যাটিকানের অধিকারী হওয়া
সত্ত্বেও, ধর্মীয় বিষয়ে ইতালির সম্পৃক্ততার মাত্রা পোল্যান্ডের চাইতে তুলনামূলকভাবে
কিছুটা কম ছিল বলে এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে ।
অন্যদিকে স্পেনের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো
বৈপরীত্য (Paradox) লক্ষ্য করা গিয়েছে। স্পেনের অধিকাংশ ক্যাথলিকদের মধ্যে রোজারী জপমালা
করবার অভ্যাস পোল্যান্ড ও ইতালির চাইতে অনেকটাই কম। তবে যারা নিয়মিত রোজারী জপমালার
প্রার্থনা করেন, তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা অন্যদের চাইতে ভাল বলেই জানা
গিয়েছে। গবেষকদের মতে, এই অবস্থা খ্রীষ্টীয় ক্যাথলিক ধর্মের সাথে স্পেনের অভ্যন্তরীণ
জটিল সামাজিক সম্পর্কের প্রতিফলন। যেখানে স্পেনের দ্রুত পরিবর্তনশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক
সামাজিকীকরণের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ক্যাথলিক ধর্মীয় অনুশীলনগুলিকেও টিকে থাকার লড়াই
করতে হচ্ছে।
মানসিক-স্বাস্থ্য সংযোগ
এই গবেষণার সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবিষ্কার হল রোজারী জপমালার প্রার্থনা
কীভাবে মানসিক-স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সক্রিয় ভাবে ভূমিকা পালন করছে তার প্রমাণ তুলে
ধরা। অংশগ্রহণকারীরা ধারাবাহিকভাবে এ কথা জানিয়েছেন রোজারী জপমালার এই অনুশীলন “আধ্যাত্মিক
শান্তি, মানসিক প্রশান্তি এবং আত্মবিশ্বাস” প্রদান করে (২৬.৩%), “জীবনের সমস্যা মোকাবেলায়”
সাহায্য করে (১০.২%), এবং “মন্দ শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষা” প্রদান করে (৮.৬%)।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেনঃ “রোজারী জপমালার প্রার্থনা আমার জীবন বাঁচিয়েছে।
আমার স্বামীর মৃত্যুর পর, আমি মানসিক যন্ত্রণা এবং একাকীত্ব সহ্য করতে পারিনি। প্রতিদিন,
আমি জপমালার প্রার্থনা করতাম। এবং রোজারী প্রার্থনার এই অভ্যাস আমাকে ওই কঠিন মুহূর্তগুলিতে
নিজেকে টিকিয়ে রাখার শক্তি দিয়েছে। এটা ছাড়া, আমি কীভাবে যে নিজেকে সামলাতাম তা
আমি জানি না।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে রোজারী জপমালার প্রার্থনা মানুষের হতাশা
হ্রাস এবং ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদি চিন্তার বৃদ্ধির সাথে ইতিবাচকভাবে সম্পর্কযুক্ত।
এই গবেষণার ফলাফলগুলি সামাজিক ভাবে পরিচিত যোগব্যায়াম ও অন্যান্য ধ্যান অনুশীলনের উপর
করা গবেষণার ফলাফলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত
যোগব্যায়াম অনুশীলন বা ধ্যান প্রার্থনা করতে গিয়ে মানুষকে সংশ্লিষ্ট কোন যোগব্যায়াম
কেন্দ্রে কিংবা মোবাইল অ্যাপে অনেক টাকা দিয়ে সদস্যপদ (Membership) কিনতে হয়, যেখানে
রোজারী জপমালা করবার জন্য কোন ব্যাক্তিকে খ্রীষ্টান হওয়ার প্রয়োজন নেই, বা তাকে কোন
ক্যাথলিক গীর্জার সদস্য হওয়ারও প্রয়োজন নেই। এটি বিনামূল্যে, নিজের বাড়িতে বসে যে কেউ
এই জপমালার প্রার্থনা করতে পারেন।
কেন এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ
এই গবেষণার প্রভাব ক্যাথলিক খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের বাইরেও বিস্তৃত।
বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সংকট বৃদ্ধির সাথে সাথে - বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এবং ইউরোপে অন্যান্য দেশের সাথে - গবেষণাটি প্রকাশ করেছে যে, আমাদের সমাজ মানসিক সুস্থতার
জন্য হাতের কাছে থাকা, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রোথিত প্রাচীন অনুশীলনগুলিকে
উপেক্ষা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরম্ভ করে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যেখানে
মানসিক সুস্থতার নামে বিভিন্ন যোগব্যায়াম কেন্দ্রগুলি প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয়
করে, সেখানে এই গবেষণার ফলাফল আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পণ্যায়ন (Industrialization) নিয়ে
প্রশ্ন তুলেছে। যেখানে ক্যাথলিক মণ্ডলীর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রোজারী জপমালার মতো আধ্যাত্মিক
অনুশীলন যখন একই রকম মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুবিধা প্রদান করে, সেখানে ব্যয়বহুল
ধ্যান ও যোগব্যায়াম ক্লাসের জন্য মানুষকে কেন কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করতে হবে? বলাই
বাহুল্য, এই গবেষণাটি এমন ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করে, যারা এই কথা মনে করেন যে পূর্বের
অখ্রীষ্টান ধর্মগুলির (Eastern Religions) (হিন্দু, বৌদ্ধ, তাও ও জেন) আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলি
পশ্চিমা দেশের ক্যাথলিক চার্চের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চেয়েও উচ্চতর ও উপকারী। স্বাভাবিক
ভাবেই এই গবেষণা তেমন সব ধারণাকে নস্যাৎ করে এবং প্রমাণ করে যে রোজারী জপমালার আধ্যাত্মিক
অনুশীলন অন্যান্য ধর্মের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চেয়ে অনেক বেশি উপকারী ও প্রভাবশালী।
জার্মানিতে, যেখানে ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় খ্রীষ্টীয় ঐতিহ্যই তাদের দেশের সংস্কৃতিকে রূপ দিয়েছে কিন্তু বর্তমানে তারা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে, এই গবেষণাটি ধর্মনিরপেক্ষ মানসিক স্বাস্থ্য পদ্ধতি এবং ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন খ্রীষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি সম্ভাব্য সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। ফলে, জার্মান ক্যাথলিকদের একাংশ, যারা রোজারী জপমালার প্রার্থনাকে, প্রায়শই “মান্ধাতার আমলের” বলে বরখাস্ত করে দিত, এই গবেষণা প্রকাশের পর তারা এ নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে বসেছে।
পোল্যান্ডের জন্য এই গবেষণার প্রভাব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই দেশ যখন তার দৃঢ়মূল ক্যাথলিক পরিচয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধর্মনিরপেক্ষকরণের রাজনৈতিক প্রভাবের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এই গবেষণাটি ঐতিহ্যবাহী রোজারী জপমালার আধ্যাত্মিক অনুশীলনের গুণাবলী ও মানসিক স্বাস্থের মূল্যের জন্য অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ (Empirical Evidence) প্রদান করে - যা স্বাস্থ্যসেবা নীতি এবং সাংস্কৃতিক বিতর্ক উভয় পক্ষকেই প্রভাবিত করে।
ইতালিতে, যেখানে খ্রীষ্টীয় ক্যাথলিক ধর্ম সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, সেখানে গবেষণায় করা অনুসন্ধান প্রকাশ করছে যে, রোজারী জপমালার মতো ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলি সহজ-উপলদ্ধ (Easily Accessible) মানসিক স্বাস্থ্য সম্পদ হিসাবে দারুন ভাবে উপকার করতে পারে, বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য, যারা ধর্মনিরপেক্ষ মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে (Secular Mental Health Therapy) কম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
সকল প্রাচীর ভেঙ্গে দেওয়া
গবেষকরা একাডেমিক বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে এক বিরাট পক্ষপাত লক্ষ্য করেছেন।
PubMed – এর মতো নামকরা একটি অনলাইন ডাটাবেস, যেখানে লক্ষ্যাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র
প্রকাশ করা হয়, সেখানে “মননশীলতা ও ধ্যানের”-
উপরে ৩০,০৬০টি এন্ট্রি রয়েছে কিন্তু “রোজারী জপমালার প্রার্থনার”- জন্য আছে
মাত্র ১৩টি এন্ট্রি। গবেষকদের মতে, এই বৈষম্য বৃহত্তর সাংস্কৃতিক কুসংস্কারকে প্রতিফলিত
করে যা প্রায়শই পশ্চিমা দেশের খ্রীষ্টীয় আধ্যাত্মিক ভক্তিগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে
দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এটা ইচ্ছাকৃত, কারণ ধর্মনিরপেক্ষ অখ্রীষ্টান গবেষকদের একটা বড়
অংশ ক্যাথলিক ধর্মের আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলির ইতিবাচক ও উপকারী দিকগুলিকে সমাজের সামনে
স্বীকার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সম্ভবত রাজনৈতিক কিংবা ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের
কারণে। মজার বিষয়, তাদের নিজেদের গবেষণায় উঠে আসা তথ্য কিন্তু তাদের ব্যাক্তিগত ধারণার
বিরুদ্ধেই প্রমাণ দিচ্ছে।
গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ধর্মময়তা সরাসরি এবং দুটি মূল পথের
মাধ্যমে মানসিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলেঃ “সহানুভূতি বৃদ্ধি” এবং “ধর্মীয়
সংগ্রাম হ্রাস”। রোজারী জপমালার পুনরাবৃত্তিমূলক প্রকৃতি - মন্ত্র ধ্যানের
অনুরূপ - এটি এমন এক ধ্যানের অবস্থা তৈরি করে যা মানুষের উদ্বেগকে শান্ত করে এবং বেপরোয়া
আবেগ নিয়ন্ত্রণকে উৎসাহিত করে। মজার ব্যাপার হলো, রোজারী জপমালার এই অনুশীলনটি সামাজিক
বিচ্ছিন্নতা বা সংকীর্ণতার সাথে কোনও দিনই সম্পর্কিত ছিল না, যেমনটি অনেক সময় ধর্মনিরপেক্ষরা
বলে থাকেন। পরিবর্তে, রোজারী জপমালার প্রার্থনা “উচ্চস্তরের বর্ধিত সহানুভূতি”র
সাথে সম্পর্কিত, যা প্রকাশ করে এটি সামাজিক সংযোগ হ্রাস করার পরিবর্তে বৃদ্ধি করে।
এর কারণ, বহুকাল থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলবদ্ধ হয়েই রোজারী জপমালার প্রার্থনা করা
হয়ে আসছে।
পুনরাবৃত্ত প্রার্থনার শক্তি
আমাদের সমাজ যখন মানসিক স্বাস্থ্যের মহামারী, আধ্যাত্মিক শূন্যতা এবং
মানসিক সুস্থতার জন্য সম্পূর্ণরূপে খাঁটি চিকিৎসা পদ্ধতির অভাবের সঙ্গে লড়াই করছে,
তখন এই গবেষণাটি মানসিক সুস্থতার চিকিৎসা পদ্ধতির আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক দিকগুলির সুবিধাগুলি
তুলে ধরেছে। রোজারী জপমালার সহজলভ্যতা - শুধুমাত্র একটি রোজারী মালা এবং আর কিছু সময়
- এটি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও লাভজনক। যেহেতু
অনেকেই থেরাপি বা ধ্যান ক্লাসের জন্য অর্থ খরচ করতে পারেন না বা করতে চান না। এই গবেষণাটি
ধর্মীয় গোঁড়ামির পক্ষে নয় বা এটা পরামর্শ দেয় না যে রোজারী জপমালার প্রার্থনা অন্যান্য
চিকিৎসা পদ্ধতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বরং, এটি মানুষের দুঃখকষ্ট মোকাবেলায় এবং জীবনের হতাশা
কাটিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এবং জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে এক অনন্য আধ্যাত্মিক
উপায়কে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেয়।
রোজারী জপমালার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
সার্বজনিক ভাবে রোজারী জপমালার উপর এমন গবেষণা এই প্রথমবার হলেও, ক্যাথলিক
মণ্ডলীর অসংখ্য ধর্মতত্ত্ববিদ, সাধুসাধীরা এবং বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতারা এর
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুনাগুণের ব্যাপারে খ্রীষ্টানদের বরাবরই বহু গুরুত্বপূর্ণ
শিক্ষা দিয়েছেন। যার অধিকাংশই অখ্রীষ্টান সমাজের কাছে অজানা। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির
দিক ছাড়িয়েও রোজারী জপমালা ক্যাথলিকদের খ্রীষ্টীয় জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
আসলে এই জপমালা একটি আধ্যাত্মিক অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। যা একটি মানুষকে অন্ধকার
জগতের বিনাশকারী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে। রোজারী জপমালাকে কেন্দ্র করে, অগণিত বইপত্র
লেখা হয়েছে। লেখা হয়েছে অনেক অনলাইন আর্টিকেল। ক্যাথলিক মণ্ডলীর বহুকালের ইতিহাস বলছে,
যারা বিশ্বস্ত ভাবে প্রতিদিন রোজারী জপমালা করেছেন, তারা তাদের জীবনের সমস্ত সংগ্রামে
বিজয়ী হয়েছেন। তাই তো দেখা গেছে, এই বিশেষ প্রার্থনা পদ্ধতি ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের বৃত
ছাড়িয়েও অন্যান্য জাতি ও ধর্মের মানুষেরা আপন করে নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছে রয়েছে
এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আপন আপন ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস। প্রকৃতপক্ষে, ধর্ম, স্বাস্থ্য,
সুস্থতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমৃদ্ধি সম্পর্কিত অনেক গবেষণা প্রতি বছর প্রকাশিত হয়,
কিন্তু প্রায় কোনও ধর্মতত্ত্ববিদই সেগুলিতে অতো মনোযোগ দেন না। তবে এই গবেষণার ফলাফল,
খ্রীষ্টান ও অখ্রীষ্টান উভয় দলের ধর্মতত্ত্ববিদদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। সময়ের সাথে
সাথে, এই গবেষণার অন্যান্য দিকগুলিও ফুটে উঠবে। তবে এ কথা একেবারে নিশ্চিত করে বলা
যেতে পারে, যারা হাতে রোজারী জপমালা ধরবে এবং এই প্রার্থনা অনুশীলন শুরু করবে, তারা
নিজেরাই এই গবেষণায় উঠে আসা সকল তথ্য ও ফলাফলের সততা নিজের জীবনে অভিজ্ঞতারুপে লাভ
করবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. New
Study Reveals the Rosary Rivals Modern Meditation for Mental Health Benefits
২. Oviedo, L., Seryczyńska, B.,
Jelińska, M. et al. Is the Rosary
Still Relevant? Exploring its Impact on Mental Health and Well-Being: A
Multinational Study. J Relig Health 64, 1173–1194
(2025). https://doi.org/10.1007/s10943-025-02265-y