ভগবদ গীতা কী সকল মানুষের জন্য দেওয়া হয়েছে?
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করেন যে, “ভগবদ গীতা” হিন্দুধর্মের
একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। যদিও পণ্ডিত মহলে এ নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে। “ভগবদ গীতা”
এই নামের অর্থ হলো; “ভগবানের গান”। ভগবদ গীতা ১৮টি অধ্যায় ও ৭০০টি শ্লোক নিয়ে
সংকলিত। এই গ্রন্থে কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কথোপকথন এবং জীবনের
আধ্যাত্মিক দিক সম্পর্কিত জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই ভগবদ গীতা আসলে বেদব্যাস
বা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস নামে পরিচিত এক ঋষির রচিত হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের, ভীষ্ম
পর্বের ২৫ হতে ৪২ তম অধ্যায় থেকে নেওয়া একটি অংশ। গীতা ভীষ্ম পর্বের অন্তর্গত
হলেও বর্তমানে অধিকাংশ হিন্দুরা এটিকে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সুতরাং এটা সত্য যে আলাদা ভাবে ভগবদ গীতা কেউ লেখেননি।
আমরা জানি যে, ইস্কন (ISKCON) এবং এই সংগঠনের অনুগামীরা ভগবদ গীতার
ব্যাপক হারে প্রচার করে থাকেন। তাদের প্রচারের মূল উদ্দেশ্য হলো সকল মানুষকে কৃষ্ণ
ভক্ত করে তোলা, সকলকে বোঝানো কৃষ্ণই আসল ঈশ্বর এবং হরিনাম জপ করাই পরিত্রাণের মূল মন্ত্র।
বর্তমানে এই সংগঠন (ISKCON) ইউরোপের বিভিন্ন খ্রীষ্টান দেশে গিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের
প্রচার করছে এবং সেখানকার মানুষকে কৃষ্ণ ভক্ত হতে আহ্বান জানাচ্ছে। আমি ব্যাক্তিগত
ভাবে মনে করি, প্রতিটি ধর্মের মানুষের তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচার করবার স্বাধীনতা
ও অধিকার আছে। কিন্তু ভারতে খ্রীষ্টানদের বেলায় সেই অধিকার নেই। এমনকি মুসলিম দেশগুলিতেও
খ্রীষ্টানদের প্রভু যীশুর মঙ্গলসমাচারকে মুক্ত ভাবে প্রচার করতে দেওয়া হয়না। এবং অধিকাংশ
ক্ষেত্রে খ্রীষ্টের প্রচারকদের হত্যা করা হয়। যদিও ভারতের সংবিধানে সকল ধর্মকে সমান
স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, তবুও বাস্তবে সেই স্বাধীনতা কতটা পালন করতে দেওয়া হয়, সেটা
আমার জানা আছে। তফাৎ কোথায় জানেন? ভারতে যখন একজন খ্রীষ্টান পবিত্র বাইবেলের বাণী প্রচার
ক’রে, প্রভু যীশু খ্রীষ্টের সম্বন্ধে মানুষের কাছে প্রচার ক’রে, তখন তাকে “মানুষের
ধর্ম পরিবর্তন করাচ্ছে” বলে গালাগালি দেওয়া হয়, অত্যাচার করা হয়, নিন্দা করা হয়!
অথচ এই একই কাজ গীতার প্রচারকেরা ও অন্যান্য হিন্দু সংগঠনগুলি বিদেশের মাটিতে, খ্রীষ্টান
দেশগুলিতে গিয়ে অবলীলায় নিশ্চিন্তে করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বেলায় এটা “ধর্ম পরিবর্তন
করানো হচ্ছে” বলা যাবে না। তারা নিজেদের বেলায় এটা মনেই করে না যে, তারা অন্যদের
ধর্ম পরিবর্তন করাচ্ছে। আমি হিন্দু পরিবারে, হিন্দু পরিবেশে বড় হয়েছি। বড়দের মুখে হিন্দু
ধর্মের মাহাত্মের কথা অনেক শুনেছি। তখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে হিন্দু ধর্মের
মধ্যে কোন দ্বিচারিতা থাকতেই পারেনা। যত সময় গেছে, বয়স বেড়েছে, ততই জেনেছি আমি ভুল
ছিলাম। সম্পূর্ণ ইউরোপ মহাদেশ পবিত্র বাইবেল ও খ্রীষ্টধর্মের আদর্শের উপর ভিত্তি করেই
গড়ে উঠেছে। সেই কারণেই ইউরোপ দেশগুলিতে গিয়ে হিন্দুরা ধর্মপ্রচার করলেও তাদের বাঁধা
দেওয়া হয়না। এমনকি হিন্দুরা বিদেশের মাটিতে গিয়ে দুর্গা পূজা, কালী পূজা কিংবা অন্যান্য
দেবদেবীর পূজাও করে। কারণ খ্রীষ্টধর্ম মানুষের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে না, এমনকি
তখনো, যখন একজন ব্যাক্তি খ্রীষ্টধর্মকে অস্বীকার করে। আপনি এটাও দেখে থাকবেন, মুসলিমরা
ইসলামিক দেশেগুলিতে থাকবার চাইতে, খ্রীষ্টান দেশগুলিতে থাকতে বেশি পছন্দ করে। এমন তারা
ইসলাম ধর্মের প্রচারও করে। এই পুরো বিষয়টি কেউ যদি নৈতিক ও যুক্তিসঙ্গত ভাবে চিন্তা
করে দেখে, তাহলে তার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হতে যাবে।
ভগবদ গীতা নিয়ে আপত্তি
যারা ভগবদ গীতার প্রচার করেন, তাদের প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কয়েকটি
প্রশ্ন আছে। তারা মানুষের কাছে ভগবদ গীতা নিয়ে যে সমস্ত জোরাল দাবীগুলি করে থাকেন,
সে সব আদৌ সত্য নয়! যেমন সনাতনী হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দাবী করেন যে, “ভগবদ গীতা সমস্ত
মানুষের জন্য! সবাইকে এই গ্রন্থ পড়া উচিত!”। এই বলে তারা অন্য ধর্মের মানুষের কাছে
গীতা বিলি করে বেড়ান। অথচ বাইবেল নিয়ে এই একই কাজ যদি একজন খ্রীষ্টান করেন, তাহলে তাকে
“ধর্ম পরিবর্তন” করানোর অভিযোগে মারধোর করা হবে। সে যাইহোক, সনাতনী হিন্দু কিংবা
ভগবদ গীতার প্রচারকদের মিথ্যাচার প্রমাণ করবার জন্য আমি চারটি প্রশ্ন করবো, যার উত্তর
তাদেরকে সরাসরি ভগবদ গীতা থেকেই দিতে হবে।
১. কৃষ্ণ নিজে এ কথা কোথায় বলেছেনঃ “গীতা সমস্ত মানুষের জন্য দেওয়া হয়েছে”?
২. কৃষ্ণ নিজে এ কথা কোথায় বলেছেনঃ “মানুষের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর গীতায় লেখা আছে”?
৩. কৃষ্ণ নিজে এ কথা কোথায় বলেছেনঃ “গীতা সমগ্র মানবজাতির জন্য একমাত্র ও চূড়ান্ত সমধান”?
৪. কৃষ্ণ নিজে এ কথা কোথায় বলেছেনঃ “গীতাই সনাতন ধর্মের একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ”?
আমি ১০০% নিশ্চিত করে বলছি, পৃথিবীর কোন সনাতনী হিন্দু, কিংবা ভগবদ
গীতার প্রচারক গীতা থেকে এই চারটি প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে পারবে না! সম্ভব নয়!
অথচ তারা কিনা ওইসব কথা বলে সেই সমস্ত মানুষদের বিভ্রান্ত করেন, লোক ঠকান; যারা হিন্দুধর্ম
সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, বা যারা গীতা ভাল করে কোনদিনও পড়েন নি। আমি নিজে ভগবদ গীতা
বহুবার পড়েছি। কিন্তু কোথাও ওই সব কথার উল্লেখ পাইনি। গীতার প্রচারকেরা সনাতন ধর্মের
সম্বন্ধে, গীতার সম্বন্ধে যে সকল আকাশ পাতাল দাবী করে থাকেন, তার ৯০% শতাংশ শাস্ত্রে
খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে সমস্তটাই তাদের ব্যাক্তিগত মনগড়া ব্যাখ্যা ও কল্পনা। আরও
দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সারা জীবনে একবারও নিজেদের ধর্মগ্রন্থ
খুলে দেখে না। ধর্মগ্রন্থে কী লেখা আছে, আর কী লেখা নেই, এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণরূপে
অজ্ঞ। আপনি জানলে হয়তো একটু অবাক হবেন, স্বয়ং কৃষ্ণ, তিনি নিজেই গীতার মধ্যে বলে দিয়ে
গেছেন যে এই ভগবদ গীতা সকল মানুষের জন্য নয়! এবং সকল মানুষকে যেন গীতা না দেওয়া হয়।
ভগবদ গীতা, ১৮ অধ্যায় এবং ৬৭ শ্লোকে কৃষ্ণ বলেছেনঃ [https://www.holy-bhagavad-gita.org]
বাংলা তাৎপর্যঃ “যারা
সংযমহীন, অভক্ত, পরিচর্যাহীন এবং আমার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন,
তাদেরকে কখনও এই গীতা দান করা উচিত নয়।”
English: “This Gita
should never be imparted to a man who is not devoted or engaged
in devotional service; and in no case to him who finds faults with me.”
কৃষ্ণ নিজে স্পষ্টই বলছেন, যাদের কৃষ্ণের প্রতি কোন ভক্তি নেই, যাদের মধ্যে কোনও সংযম নেই, এবং যারা কৃষ্ণের মধ্যে ভুলত্রুটি খুঁজে পায়, তাদেরকে এই ভগবদ গীতা এবং এর জ্ঞান দেওয়া যাবে না। তাহলে কী ভাবে সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সকলকে গীতা পড়বার পরামর্শ দেন? কেনই বা তারা এই মিথ্যা কথা বলেন যে, গীতা সকল মানুষের জন্য? একজন ব্যাক্তি যিনি কৃষ্ণ কে বিশ্বাস করেন না, বা যিনি কৃষ্ণের চরিত্রকে নিন্দা করেন, তাকে কী কখন গীতা দেওয়া যেতে পারে? মূল কথা হলো, আপনি যদি এমন একজন ব্যাক্তি হন, যার মনে হয় কৃষ্ণ আসলে ঈশ্বর নন, কৃষ্ণকে ভক্তি করা উচিত নয়, এর পরেও কোন হিন্দু আপনার কাছে কৃষ্ণের নাম প্রচার করতে পারে না, আপনার হাতে একটা ভগবদ গীতা তুলে দিতে পারে না, আপনাকে গীতার জ্ঞান দিতে পারে না। তারা যদি এমনটা করে, তাহলে প্রমাণ হবে যে, তারা কৃষ্ণের বাণী মানে না এবং গীতার প্রতিও তাদের কোন শ্রদ্ধা নেই।