ঈশ্বরের অস্তিত্ব কী প্রমাণ করা সম্ভব?
ঈশ্বরের সম্বন্ধে যা কিছু জানা যায়, তাদের কাছে তা তো স্পষ্টই হয়ে আছে; কেন না ঈশ্বর তাদের কাছে তা প্রকাশ করেছেন। জগতের সৃষ্টিকাল থেকে তাঁর অদৃশ্য গুণাবলী, তাঁর সেই চিরস্থায়ী শক্তি ও তাঁর ঈশ্বরত্ব, সে তো মানুষের বুদ্ধিগোচর হয়েই আছেঃ তাঁর সৃষ্টির সবকিছুর মধ্য দিয়েই তা উপলব্ধি করা যায়। তাই সপক্ষে বলার মতো তাদের কাছে আর কিছুই নেই। কেন না ঈশ্বরকে জেনেও তারা ঈশ্বরকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানায়নি। তাদের ধ্যানধারনা বরং সম্পূর্ণ অসার হয়ে উঠেছে, তাদের অবোধ অন্তরটাও অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, নিজেদের জ্ঞানী ব’লে জাহির ক’রে তারা মূর্খ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। (রোমীয় ১:১৯-২২)
ঈশ্বরের অস্তিত্ব কী প্রমাণ করা সম্ভব? এই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য ও সঠিক উত্তর দেওয়ার আগে, আমাদের প্রথমে এমন
পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য করতে হবে যা প্রায়শই বহু মানুষ এড়িয়ে
যান, বা অনেকেই এই প্রশ্নগুলি করেন না।
প্রথম,
প্রশ্ন হলো কোনকিছুর অস্তিত্ব আছে না নেই? কিন্তু আমরা জানি বা না জানি,
কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে।
দ্বিতীয়,
প্রশ্ন হলো, কোনকিছুর যদি অস্তিত্ব থাকে, তবে আমরা কী জানি
যে সেটার অস্তিত্ব আছে?
এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক ভাবে দেওয়া মানে, ধরে নেওয়া হবে যে প্রথম
প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক ভাবে ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের জ্ঞানের
বাইরেও কোনকিছুর অস্তিত অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু তবুও আমাদের পক্ষে কোনকিছুর অস্তিত্ব
সম্বন্ধে জানা সম্ভব নয়, যদি বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্বই না থাকে।
তৃতীয়,
কোনকিছুর অস্তিত্বের বিষয়ে আমাদের যে জ্ঞান আছে, তার পিছনে
কোন কারণ আছে কিনা, এ প্রশ্নও আছে!
আমরা কিছু জিনিস জানতে পারি, কিন্তু যুক্তি দ্বারা সকলকে সেই জ্ঞানের
দিকে পরিচালনা করতে পারি না। অনেক খ্রীষ্টান মনে করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার
ব্যাপারটা এরকমই।
চতুর্থ,
এবার প্রশ্ন হলো, যদি কারণ থাকে, তাহলে সেটা প্রমাণ হিসেবে
গ্রহণ করা যাবে কিনা!
বেশির ভাগ কারণই কিন্তু প্রমাণ নয়! আমরা যা কিছু বিশ্বাস করি তার সপক্ষে
যে সমস্ত কারণগুলি আমরা দেখাই তার বেশিরভাগই সম্ভাব্যতা, প্রমাণ নয়। উদাহরণ, আপনি যে
অট্টালিকায় বসে আছেন সেটা এক মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়তে পারে, কিন্তু যিনি এই অট্টালিকা
নির্মাণ করেছেন এবং যে সমস্ত নির্মাণ সামগ্রীর ব্যাবহার করা হয়েছে, এদের নির্ভরযোগ্যতা
আপনার কাছে একটি জোরালো কারণ বলে মনে হতে পারে যে, এই অট্টালিকা ভেঙ্গে পড়াটা অসম্ভব।
পঞ্চম,
যদি প্রমাণ থাকে, তবে কী এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতি দ্বারা প্রমাণিত, যেমনঃ পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ?
দার্শনিক প্রমাণগুলিও ভালো প্রমাণ হতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনীয় নয় সেগুলি
বৈজ্ঞানিক হতে হবে!
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার জন্য প্রথম থেকে চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব, কিন্তু পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা সহজ হবে না। তবে আমি অসম্ভব বলেও মনে করছি না। ঈশ্বর আছেন, আমরা তা জানতে পারি, তার সপক্ষে আমরা কারণ দিতে পারি, এবং সেই কারণগুলি প্রমাণের সমান, কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নয়, অস্বাভাবিকভাবে বিস্তৃত অর্থে ছাড়া। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে, অধিকাংশ যুক্তির একই যৌক্তিক কাঠামো রয়েছে, যা যেকোনো নির্ণয়মূলক যুক্তির (Deductive Argument) মৌলিক কাঠামো হিসেবে আমরা তা দেখতে পাই। প্রথমত, একটি প্রধান ভিত্তি বা সাধারণ নীতি থাকে। তারপর, একটি গৌণ ভিত্তি আমাদের অভিজ্ঞতার কিছু নির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করে যা সেই নীতির আওতায় আসে। অবশেষে, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সেই সাধারণ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি আসে। প্রতিটি যুক্তির ক্ষেত্রেই সর্বশেষ সিধান্ত হল যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু বিভিন্ন যুক্তির ভিত্তি ভিন্ন। যুক্তিগুলি ঠিক যেন রাস্তার মতো, তারা বিভিন্ন সূচনা কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে সবগুলি গিয়ে একই গন্তব্যস্থলে এসে মিলিত হয়েছে, এই গন্তব্যস্থল হলো ঈশ্বর। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যে সমস্ত জনপ্রিয় যুক্তিগুলি (Arguments) আছে, আমার পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে সে নিয়ে আলোচনা করবো। তার সাথে অতিরিক্ত ভাবে সেই সকল বিজ্ঞানীগণ, লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিকগণ এবং প্রাক্তন নাস্তিকগণের যুক্তি, তর্ক ও পড়াশোনা নিয়েও আলোচনা করবো যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কথা বলেছেন। অতএব, এই নিবন্ধ দিয়েই আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্বন্ধে আমার প্রারম্ভিক আলোচনা ও বিশ্লেষণ শুরু করলাম।