যুদা ইস্কারিয়োৎ, যীশুর খ্রীষ্টের
বারোজন প্রেরিত শিষ্যদের একজন ছিলেন (মথি ১০:২-৪)।
তিনি অন্যান্য প্রেরিত শিষ্যদের সঙ্গে বাণী প্রচারের কাজেও নিযুক্ত ছিলেন (মথি ১০:৫)। অথচ এই যুদা একদিন অর্থের লোভে, তিরিশটি রুপোর
টাকার বিনিময়ে যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে শত্রুদের হাতে তুলে দিয়েছিল (মথি ২৬:১৪-১৬)। এরপরেই যুদার মৃত্যু হয়। এখন প্রশ্ন হল, যুদা
ইস্কারিয়োৎ কী ভাবে মারা গিয়েছিল? কারণ অনেকের মতে যুদার মৃত্যুর বিষয়ে বাইবেলে দুরকমের
কথা বলা হয়েছে। বিশেষ ভাবে মুসলিমরা এই বিষয়কে কেন্দ্র করে খ্রীষ্টানদের কাছে বাইবেলের
সত্যনিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা ক’রে। সত্যিই কি যুদার মৃত্যুর
বিষয়ে বাইবেলে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দেওয়া হয়েছে? আসুন, এখন আমরা বাইবেলের সেই
দুটি অংশ পড়ে দেখি, সেখানে যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যুর বিষয়ে ঠিক কি বলা হয়েছে।
সাধু মথি লিখছেনঃ
এদিকে যুদা, যিনি যীশুকে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেই যুদা যখন দেখলেন যে যীশুকে দণ্ডিত করা হয়েছে, তখন তাঁর মনে অনুশোচনা এল। তিনি তাই প্রধান যাজকদের ও প্রবীণদের কাছে সেই তিরিশটি রুপোর টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললেনঃ “আমি পাপ করেছি! একজন নির্দোষ মানুষকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি!” কিন্তু তাঁরা বললেনঃ “তাতে আমাদের কী? এ তো তোমার ব্যাপার!” তখন তিনি ওই টাকাগুলো মন্দিরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। এক জায়গায় গিয়ে তিনি গলায় দড়ি দিয়ে মরলেন। এদিকে প্রধান যাজকেরা ওই টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বললেনঃ “এগুলো তো মন্দিরের কোষাগারে দিতে নেই। কেন না এ যে রক্তের মূল্য!” তাই পরামর্শ করার পর ওই টাকা দিয়ে তাঁরা বিদেশীদের সমাধি দেবার জন্যে কুমোরের জমিটি কিনলেন। সেই জন্য আজও পর্যন্ত ওই জমিটাকে বলা হয় রক্তের জমি। (মথি ২৭:৩-৮)
মূল গ্রীক পাঠঃ
[τότε ἰδὼν ἰούδας ὁ παραδιδοὺς αὐτὸν ὅτι κατεκρίθη μεταμεληθεὶς ἔστρεψεν τὰ τριάκοντα ἀργύρια τοῖς ἀρχιερεῦσιν καὶ πρεσβυτέροις. λέγων, ἥμαρτον παραδοὺς αἷμα ἀθῶον. οἱ δὲ εἶπαν, τί πρὸς ἡμᾶς; σὺ ὄψῃ. καὶ ῥίψας τὰ ἀργύρια εἰς τὸν ναὸν ἀνεχώρησεν, καὶ ἀπελθὼν ἀπήγξατο. οἱ δὲ ἀρχιερεῖς λαβόντες τὰ ἀργύρια εἶπαν, οὐκ ἔξεστιν βαλεῖν αὐτὰ εἰς τὸν κορβανᾶν, ἐπεὶ τιμὴ αἵματός ἐστιν. συμβούλιον δὲ λαβόντες ἠγόρασαν ἐξ αὐτῶν τὸν ἀγρὸν τοῦ κεραμέως εἰς ταφὴν τοῖς ξένοις. διὸ ἐκλήθη ὁ ἀγρὸς ἐκεῖνος ἀγρὸς αἵματος ἕως τῆς σήμερον.]
সাধু লুক লিখছেনঃ
এই যুদা আমাদেরই একজন ছিল; আমাদের সঙ্গে সেও একই সেবাদায়িত্ব পেয়েছিল। এখন, তার ওই হীন কাজটা করে যে টাকা পেয়েছিল, তা দিয়ে সে তো একটা জমি কিনেছিল; আর সেখানেই কিনা উঁচু থেকে সে এমন ভাবে উল্টে পড়ে গিয়েছিল যে, তার পেট ফেটে গিয়েছিল, নাড়িভুঁড়ি সব বেড়িয়ে পড়েছিল। জেরুসালেমের সকলেই এ কথাটা জানতেও পেরেছিল, আর তাই তাদের ভাষায় ওই জমিটির নাম হয়ে গিয়েছিল আকেল্দামা, অর্থাৎ, রক্তের জমি। (শিষ্যচরিত ১:১৭-১৯)
মূল গ্রীক পাঠঃ
[ὅτι κατηριθμημένος ἦν ἐν ἡμῖν καὶ ἔλαχεν τὸν κλῆρον τῆς διακονίας ταύτης. οὖτος μὲν οὗν ἐκτήσατο χωρίον ἐκ μισθοῦ τῆς ἀδικίας, καὶ πρηνὴς γενόμενος ἐλάκησεν μέσος, καὶ ἐξεχύθη πάντα τὰ σπλάγχνα αὐτοῦ. καὶ γνωστὸν ἐγένετο πᾶσι τοῖς κατοικοῦσιν ἰερουσαλήμ, ὥστε κληθῆναι τὸ χωρίον ἐκεῖνο τῇ ἰδίᾳ διαλέκτῳ αὐτῶν ἁκελδαμάχ, τοῦτ᾽ ἔστιν, χωρίον αἵματος.]
সাধু মথি ও সাধু লুক তাঁরা দু’জনে
তাঁদের লেখায় যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যুর যে বর্ণনা দিয়েছেন তা পড়বার পর অনেকের মনে
হতেই পারে যে, তাঁদের লেখার মধ্যে অমিল রয়েছে। এখানে কোনটা সত্যি? যুদা ইস্কারিয়োত
গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়? না কি উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়? উত্তর হল, মঙ্গলসমাচার
লেখকদের কথায় আদৌ কোনও অমিল বা বৈপরীত্য (Contradiction) নেই। আসলে এখানে পাঠকদের বুঝতে
ভুল হয়। কারণ সাধু মথি তাঁর লেখায় যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যু কি ভাবে ঘটেছিল সেটাই
বর্ণনা করেছেন; ওদিকে সাধু লুক, যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের কি অবস্থা
হয়েছিল সেটাই বর্ণনা করেছেন। এই সুক্ষ পার্থক্য তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, যারা
এই ঘটনার ঐতিহাসিক তথ্য সম্বন্ধে অবগত নন এবং যারা বাইবেলের ঐশতাত্ত্বিক পদ্ধতিমূলক
(Systematic Theology) ব্যাখ্যা করতে জানেন না।
ঘটনার ঐতিহাসিক বিবরণ
যুদা ইস্কারিয়ৎ যে স্থানে গিয়ে
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, তার নাম হল ‘আকেল্দামা’ (Aramaic: חקל דמא or 𐡇𐡒𐡋
𐡃𐡌𐡀 Ḥaqel D'ma, “field of blood”; Hebrew: חקל דמא), জেরুসালেমে
অবস্থিত “কুমোরের জমি” নামে পরিচিত যা ইহুদী যাজকেরা যুদার বিশ্বাসঘাতকতার টাকায়
কিনে এনে ছিল (ম্যাপে দেখবার জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক করুন)। ১৯শ শতকের
শুরুর সময় পর্যন্ত এই স্থানে বিজাতীয় এবং অ-ইহুদীদের মৃতদেহ কবর দেওয়া হতো । এই ‘আকেল্দামা’, জেরুসালেম শহরের
প্রাচীরের বাইরের দিকে, জনমানবহীন এলাকায় রয়েছে। যখন কোনও মানুষ আত্মহত্যা করতে চায়,
সে তো এমনই এক স্থানের খোঁজ ক’রে যেখানে মানুষজন তেমন একটা যাতায়াত করে না, লোকবসতি
নেই ও সাথে নির্জন! তাই যুদার পক্ষে ঐ স্থানটি ছিল একেবারে যথাযথ। সে সেখানে একটি গাছের
ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার মৃতদেহ ঐ গাছে ঝুলতে থাকে এবং দেহ পচতে শুরু
করে। নির্জন স্থান হওয়ার কারণে গাছে ঝুলতে থাকা ওই পচে যাওয়া মৃতদেহ সহজে কারও চোখেও
পড়েনি। তাছারও মোশীর বিধান অনুসারে কোনও ইহুদীর পক্ষে মৃতদেহের কাছে যাওয়া ও তা স্পর্শ
করা নিষেধ ছিল (গণনা পুস্তক ১৯:১১)। যারা বিশ্বাসঘাতকতা
করতো, তাদের মৃতদেহের ক্ষেত্রেও ওই একই নিয়ম প্রযোজ্য ছিল। অবশেষে একসময় প্রাকৃতিক
নিয়মে যুদার পচাগলা মৃতদেহ দড়ি ছিঁড়ে উপর থেকে পাথুরে সমতল ভূমিতে আছাড় খেয়ে পড়ে এবং
সেই আঘাতে মৃতদেহের পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি সব বেড়িয়ে পড়ে। তারপর সেখানকার স্থানীয় কোনও
লোক যুদা ইস্কারিয়োতের মৃতদেহ ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, সে গিয়ে অন্য লোকদের সে কথা
জানায়। তাকে সেখানেই সমাধি দেওয়া হয়।
উল্লিখিত ঘটনার সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় দ্বিতীয় শতাব্দীর ইতিহাসবিদ পাপিয়াসের (Papias) লেখায়, যিনি ১২০ খ্রীষ্টাব্দে যুদার মৃত্যুর বিষয়ে বর্ণনা করে গিয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন চতুর্থ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আপল্লিনারিউস (Apollinarius of Laodicea), তিনিও পাপিয়াসের কথা সমর্থন করে যুদার মৃত্যুর বিষয়ে একই কথা তার পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ করে গেছেন। অতএব, এ থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যুর বিষয়ে বাইবেলে যা কিছু লেখা হয়েছে তাতে তথ্যগত দিক দিয়ে কোনও ভুল বা বৈপরীত্য নেই। ইতিহাসের সাক্ষ্য পূর্ণমাত্রায় সেই সমর্থন দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টমণ্ডলীর প্রাচীন ঐতিহাসিক অনেক দলিলে যুদা ইস্কারিয়োতের মৃত্যুর বিষয়ে জোরালো বহু প্রমাণ লিপিবদ্ধ করা আছে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, মঙ্গলসমাচারের লেখকেরা তাদের ব্যাক্তিগত পেশার স্বভাব অনুসারে যুদার মৃত্যুর বিষয়টিকে তাঁর পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সাধু মথি, পেশায় একজন করগ্রাহক (Tax Collector) হওয়ার কারণে, তিনিই কেবলমাত্র “তিরিশটি রুপোর” টাকার কথা উল্লেখ করেছেন। সাধু লুক, তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক হওয়ার কারণে যুদার মৃতদেহের কি অবস্থা হয়েছিল সেটাই আমাদের জানিয়েছেন। তবে এখনও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আর তা হলঃ
কুমোরের সেই জমিটি আসলে কে ক্রয় করে ছিল? যুদা ইস্কারিয়োৎ নিজে (শিষ্যচরিত ১:১৮), না কি ইহুদী যাজকেরা (মথি ২৭:৭)?
এর উত্তর হল, ইহুদী যাজকেরা যুদার নামে কুমোরের সেই জমিটি ক্রয় করেছিল। তাদের পক্ষে যীশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য দেওয়া সেই তিরিশটি রুপোর টাকা নিজেদের কাজে ব্যাবহার করা ছিল বিধান বিরুদ্ধ কাজ (গণনা পুস্তক ৩৫:৩১)। এখানে ইহুদী যাজকেরা মৃত যুদা ইস্কারিয়োত এবং যে কুমোরের কাছ থেকে ওই জমি ক্রয় করেছিল, এই দুই পক্ষের মাঝখানে “মধ্যবর্তী মাধ্যমে”র (Intermediaries) ভূমিকা পালন করেছে। ইহুদী সমাজে এই নিয়ম চালু আছে। মৃত ব্যাক্তির নামে কেউ কোনও জমি বা সম্পত্তি ক্রয় করলে সেটা মৃত ব্যাক্তি ক্রয় করেছে বলেই মেনে নেওয়া হবে। এছাড়াও ইহুদী যাজকেরা ঐ ক্রয় করা জমির কাগজপত্রে নিজেদের নাম জড়াতে চাইনি। কারণ তাতে ধর্মীয় অশুচিতার দোষে ওই যাজকদের সামাজিক ভাবে মানুষের কাছ থেকে বহিষ্কৃত হতে হতো। যেহেতু যুদা তিরিশটি রুপোর টাকার বিনিময়ে যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাই ওই টাকা অভিশপ্ত! ওই টাকার বিনিময়ে যীশুর রক্ত ঝরানো হয়েছে যখন, সেই টাকা দিয়েই ঈশ্বরের উপাসনায় যুক্ত যাজক নিজের নামে জমি ক্রয় করবার অর্থ হল, নিজের মাথার উপর অভিশাপ ডেকে নিয়ে আসা। কেনই বা তারা যুদা ইস্কারিয়োতের পাপের ভাগীদার হতে যাবে? এ কথা জেনেই যুদার নামে ইহুদী যাজকেরা “মধ্যবর্তী মাধ্যমে”র ভূমিকা পালন করে নিজেদের কাজ সেরে ছিল। বাইবেলে “মধ্যবর্তী মাধ্যমে”র এ ধরণের কয়েকটি উদাহরণ আছেঃ (মথি ২৭:৫৯-৬০, মার্ক ১৫:১৫ ও যোহন ৪:১-২)। এই সকল প্রমাণাদি আমাদের সামনে বাইবেলের বিভিন্ন রচনাশৈলী তুলে ধরে এবং তার সাথে ইহুদী সমাজের সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য পরিবেশন করে, যা আধুনিক যুগের বাইবেল পাঠকের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই অজানা।
তথ্যসূত্রঃ
১. Cold-Case Christianity: A Homicide Detective Investigates the Claims of the Gospels by J. Warner Wallace.
২. Monte Shanks, Papias and the New Testament, chapter 4, fragment 6.
৩. https://en.wikisource.org/wiki/Catholic_Encyclopedia_(1913)/Haceldama
৪. Schick, Palestine Expl. Fund, Quarterly Statement (1892), 283-9; Conder and Warren, The Survey of Western Palestine, Jerusalem (London, 1884), 380.